Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 7:01 pm

জনতা ব্যাংকের মুনাফার অর্ধেকই দুই করপোরেট শাখার পেটে

শেখ আবু তালেব: ঋণ কেলেঙ্কারি ও আর্থিক অনিয়মে সমালোচিত হয়ে আসছে একসময় ভালো অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা ব্যক্তিরাই এখন ব্যাংকটির নেতৃত্বে রয়েছেন। এতে বছর শেষে বাড়ছে লোকসানি শাখার সংখ্যা ও পরিমাণ; কমছে মুনাফা, বাড়ছে খেলাপি ঋণ। পরিচালন মুনাফার অর্ধেকের বেশিই চলে যাচ্ছে লোকসান গুনতে।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে ব্যাংকটির মোট পরিচালন মুনাফার প্রায় ৫৪ শতাংশই চলে গেছে দুটি শাখার লোকসান গুনতে। এ শাখা দুটি হলো প্রধান কার্যালয় ও জনতা ভবন করপোরেট শাখা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই ব্যাংকটির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মূলত বিসমিল্লাহ, অ্যানন টেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে এসব লোকসান দিতে হয়েছে ব্যাংককে। এর সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু ঋণ কেলেঙ্কারি।

জানা গেছে, ২০১৯ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয় এক হাজার ৫২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরিচালন মুনাফার এই অঙ্কটি হচ্ছে সারা দেশে বিস্তৃত ১৬টি বিভাগীয় শাখা এবং করপোরেট ও সাধারণ শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে লোকাসন গুনে জনতা ভবন করপোরেট শাখা। ২০১৯ সালে শাখাটিতে লোকসান হয় ১২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

অপরদিকে প্রধান কার্যালয়ে লোকসান হয় ৬৮৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। দুই শাখায় মোট লোকসান হয় ৮১৯ কোটি টাকা, যা মোট পরিচালন মুনাফার ৫৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। বড় অঙ্কের লোকসান দেওয়ায় আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা কমে দাঁড়ায় ৭০৯ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকে ২০১৯ সালে দুজন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন হচ্ছেন লুনা শামসুদ্দোহা, যিনি ২০১৮ সাল থেকে দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ছিলেন জামাল উদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন অধ্যাপক এসএম মাহফুজুর রহমান।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে জনতা ব্যাংকের ২০১৯ সালে দায়িত্ব পালন করা চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা ও জামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এসএমএসও দেওয়া হয় একাধিকবার। কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেননি। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস ছালাম আজাদকেও ফোনকল ও এসএমএস দেওয়া হয় একাধিকবার। তিনিও কোনো উত্তর দেননি।

পরে এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএম মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকের লোকসান হয় মূলত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে। ব্যাংকের বিনিয়োগ, কস্ট অব ফান্ড ও রিটার্নে মিসম্যাচ হলেই লোকসান গুনতে হয়। এর সঙ্গে রয়েছে খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়া। সুদ আয় কমলেও পরিচালন ব্যয় কিন্তু কমছে না। এজন্য লোকসানটি মূলত পুঞ্জীভূত। এ কারণে পরিচালন ব্যয়ে জনতা ব্যাংক নজরদারি শুরু করেছে। শুধু জনতা ব্যাংকই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো উচ্চহারের খেলাপি ছিল। এ থেকে বর্তমানে ব্যাংকগুলো বেরিয়ে আসছে। সামনের দিকে পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন হবে।’

জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই বড় লোকসান দিচ্ছে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ২০১৯  সালে সর্বোচ্চ পরিমাণ ৬৮৯ কোটি টাকা লোকসান দেয়। ২০১৮ সালে লোকসান গুনে ৪৬৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ২২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বা ৪৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৭ সালেও লোকসান দেয় ২৭৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

এর পরই রয়েছে জনতা ভবন করপোরেট শাখা। এই শাখাটিই ২০১৯ সালে লোকসান দেয় ১২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আলোচিত সময়ে শাখাটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯০৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৮০৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে যায় পাঁচ হাজার ৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। শাখাটি এ সময়ে আগের খেলাপি থেকে মাত্র ১১৭ কোটি ও রাইট অফ থেকে এক কোটি টাকা আদায় করতে পারে। অথচ ২০১৮ সালে শাখাটি লোকসান দেয়নি। আলোচিত সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত ব্যাংকটিতে বছর শেষে লোকসানি শাখার সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৯ সাল শেষে মোট শাখার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯১৪টি। এর মধ্যে কোর ব্যাংকিং সলিউশনের (সিবিএস) আওতায় অনলাইন ব্যাংকিং চালু হয় ৬৭৫টিতে।

শাখার মধ্যে বিশেষায়িত করপোরেট শাখা হচ্ছে দুটি ও করপোরেট শাখা হচ্ছে ১০৫টি। ২০১৯ সাল শেষে লোকসানি সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০টি। ২০১৯ সালে সবচেয়ে ভালো শাখার সংখ্যা হচ্ছে ১০টি, ভালো মানের ৬৯টি, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ১০০টি এবং মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় এ ধরনের শাখার সংখ্যা ৫৭টি। খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শাখা হচ্ছে ১৬টি। ভালো মানের চেয়ে খারাপ শাখার সংখ্যাই বেশি। ২০১৯ সালে ৬৭টি শাখার মানোন্নয়ন হলেও অবনতি হয়েছে ৮৬টির।

ক্রমাগত লোকসান বৃদ্ধিতে তিন বছর ধরেই কমছে জনতা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল এক হাজার ১৬৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ৯৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ২০১৯ সালে ৭০৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে পরিচালন মুনাফা কমে ২৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

ফলে কর-পরবর্তী মুনাফায়ও ধস নামে। ২০১৭ সালে কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ২৬৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালে ছিল ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে নিট মুনাফার প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক এক দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। অথচ এই সময়ে ব্যাংকের ঋণ, আমানত ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ সব সূচকেই বৃদ্ধি পায়।

এই সময়ে ব্যাংকের সুদ আয় ২০১৯ সালে হয় তিন হাজার ৩৩৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল তিন হাাজার ৪৪৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুদ আয় কমেছে তিন দশমিক শতাংশ। কিন্তু সুদ ব্যয় ঠিকই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খাতে ছয় দশমিক ৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভিশনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে প্রভিশন রাখতে হয়েছিল ব্যাংকটির তিন হাজার ২৯০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে সেখানে রাখতে হয় তিন হাজার ৮৪২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ৫৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেশি প্রভিশন রাখতে হয়।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৯ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধি হয় দুই দশমিক ৩৫ শতাংশ। অপরদিকে বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ছিল ৫৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিচালন মুনাফা হয় ৭০৯ কোটি টাকা, যা কর-পরবর্তী হয় ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ব্যাংকের শ্রেণিকৃত অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।