জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মিরাশার চাষি বাজার

প্রতিনিধি, শরীয়তপুর: মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য না থাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে শরীয়তপুরের মিরাশার চাষি বাজার। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় এক থেকে দেড় কোটি টাকার শাকসবজি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ নানা কৃষিপণ্য। কৃষকেরা বলছেন, বাজারটিতে সরাসরি পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন পণ্য। নেই কোনো মধ্যস্বত্বভোগী। দেয়া লাগে না টোল, নেই চাঁদার হয়রানি।

জানা যায়, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নে শরীয়তপুর-ঢাকা মহাসড়কের পূর্ব পাশে গড়ে তোলা হয় মিরাশার চাষি বাজার বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড পরিচালিত ‘মিরাশার চাষি বাজার’। ৩২ শতক জমিতে শুরু হলেও বর্তমানে এর আয়তন দ্বিগুণ। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কৃষিবাজারে পরিণত হয়েছে এটি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং উপজেলা প্রশাসন ও সমবায় কার্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাজারটির পথচলা শুরু। কৃষক সমবায় ভিত্তিতে বাজারটিতে এখন ৮০টি ঘর তুলে এ অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কেনা-বেচা করছেন সহস্রাধিক পাইকার। পদ্মা সেতু চালুর পর পুরো দৃশ্যপট বদলে গিয়ে মিরাশার চাষি বাজার এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপসহ বিশ্ববাজারে নাম করে নিয়েছে। বছরে এই বাজারে এখন প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার সবজি বেচা-কেনা হয়। বাজারে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় কৃষকদের কোনো খাজনা দিতে হয় না। ফলে কৃষকরা এখন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন।

জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, চাষি বাজারটি কেবল কৃষকদেরকেই লাভবান করছে না, পদ্মা সেতুর সুফলকে কাজে লাগিয়ে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের এই সময়ে শরীয়তপুরকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

মিরাশার চাষি বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পাইকার মো. আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, এ বাজারের করলা, বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পটোলসহ নানা সবজি নিয়মিত বেচা-কেনা হয়। এসব সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, ভোলাসহ সিলেট, শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা ও ময়মনসিংহ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা কিনে নেন।

এ বাজারে টাটকা সবজি পাওয়া যায় বলে চাহিদাও অনেক বেশি। এ ছাড়া ২০২২ সাল থেকে এখানকার কিছু সবাজি ইংল্যান্ড, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই বাজারে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত ভরা মৌসুমে এই বাজারে প্রতিদিন তিন কোটি টাকার এবং বাকি ছয় মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ টাকার সবজি বেচা-কেনা হয়। এখানে কৃষকদের কাছ থেকে কোনো খাজনা নেয়া হয় না বলে দিনে দিনে বাজারে কৃষকের উপস্থিতি বাড়ছে। ভরা মৌসুমের ছয় মাস এই বাজারে প্রতিদিন সহস্রাধিক কৃষক ও বাকি ছয় মাস পাঁচ শতাধিক কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সরাসরি এখানে বিক্রি করেন।

জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নের মিরাশার গ্রামের কৃষক মো. মোশারফ মোল্লা বলেন, মিরাশার চাষি বাজারটি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এ বাজারটি প্রতিষ্ঠার আগে আমাদের সবজি দালালদের (মধ্য সুবিধাভোগী) দৌরাত্ম্যের কারণে তুলনামূলকভাবে কম দামে বিক্রি করতে হতো। আবার দূরের বাজারে গেলে অনেক খাজনাও দিতে হতো। কিন্তু মিরাশার চাষি বাজার বহুমুখী সমবায় সমিতি চালু হওয়ার পর থেকে এখন আমাদের সবজি খুব সহজেই ভালো দামে বিক্রি করতে পারছি। ক্ষেত থেকে সবজি তুলে অত্যন্ত সহজে বাজারে নিয়ে আসতে পারছি কম খরচে। তাই আগের তুলনায় আমাদের লাভও হচ্ছে বেশি। তাছাড়া আমাদের দিনের কৃষিকাজ শেষ করে অতি সহজেই এখানে নিয়ে আসতে পারি। বাজার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছ থেকে কোনো খাজনা আদায় করে না।

মিরাশার চাষি বাজার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. প্রিন্স খান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাজারটিতে কৃষক ও পাইকারদের হয়রানি বন্ধে কমিটির লোকজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। কোনো অভিযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সমাধান করা হচ্ছে। ৩২ শতক জমির প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হলেও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এখন এ বাজারের পরিধি তিন একরের ওপরে। এ বাজারটির সুনাম এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে এখানকার সবজি এখন খুব সহজেই ঢাকাসহ দেশের বাজারে পৌছে যেতে পারছে। ফলে জাজিরার কৃষকরা এখন আগের তুলনায় আরও বেশি লাভবান হচ্ছেন।

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. রবীআহ নুর আহমেদ বলেন, মিরাশার চাষি বাজারটি কৃষক সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় কৃষকরাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। কৃষিপণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি, যাতে মানসম্মত সবজি উৎপাদন করে কৃষকরা বেশি দাম পান। বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়েও আমরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। তাছাড়া পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে মিরাশার চাষি বাজারের বেচা-কেনার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের এই সময়ে বাজারটি জেলার কৃষিকে এগিয়ে নিতে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০