Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:37 pm

জনপ্রিয় হচ্ছে জারবেরার বাণিজ্যিক চাষ

জারবেরা অ্যাসটারেসি পরিবারভুক্ত একটি বাণিজ্যিক ফুল। জার্মান উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসক ট্রগোট জার্বারের নামানুসারে এ ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক ফুলবাণিজ্যে কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে উল্লেখযোগ্য ১০টি ফুলের একটি। বেশিদিন ফুলদানিতে সতেজ থাকতে জারবেরার জুড়ি নেই।
ইউরোপে জনপ্রিয় এ জারবেরা। বিদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে রাজধানীর সাভার উপজেলায়।
সাভার কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, সাভারের বিভিন্ন এলাকায় এখন ৫০০ হেক্টর জমিতে নানা ধরনের ফুলের চাষ হলেও শুধু জারবেরার চাষ হচ্ছে প্রায় ৫০ হেক্টরে। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগড়াকান্দা গ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে জারবেরা ফুলের চাষ হচ্ছে। এসব গ্রামের উঁচু ও বন্যামুক্ত বেলে-দোঁয়াশ মাটি জারবেরা চাষের জন্য উপযুক্ত। এরই মধ্যে সাভারের প্রতিষ্ঠিত ফুল ব্যবসায়ী নাসির হোসেন, ফারুক হোসেন, কামাল হোসেন, আশরাফ মিয়া, বিল্লাল হোসেন ও মীর মহিউদ্দিন আহমেদ বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা চাষে সফলতার মুখ দেখেছেন। এ অঞ্চলে জারবেরা চাষে তারাই অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
সরেজমিনে ও চাষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জারবেরার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সাভারের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার কাছে জারবেরা চাষ এখন লাভজনক হিসেবে সমাদৃত হয়ে উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে এখন গোলাপ ও গ্ল্যাডিউলাস চাষের পাশাপাশি জারবেরা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। সাভারে উৎপন্ন এ ফুল রফতানি না হলেও রাজধানীসহ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উৎপাদিত জারবেরা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। একই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে ধারণা উদ্যোক্তাদের।
বিরুলিয়া ইউনিয়নের আইঠর গ্রামের নাসির হোসেনের জারবেরা বাগানের কর্মচারী আজিবর বলেন, ভারত থেকে আনা টিস্যুকালচারের জারবেরার চারাপ্রতি খরচ হয়েছে ৮০ টাকা। আর রোপণ করতে খরচ হয়েছে আরও ২০ টাকা। এরপর শেড তৈরির মাধ্যমে এক ফুট পরপর লাগানো চারা রোপণের পর পর্যায়ক্রমে সেচ ও কীটনাশক দেওয়া হয়েছে। একটি পূর্ণাঙ্গ চারা থেকে দুবছর পর্যন্ত ফুল সংগ্রহ করা যায়। একটি গাছ থেকে অন্তত ১৫০ থেকে ১৬৫টি ফুল সংগ্রহ করা সম্ভব।
মূলত বাগান তৈরির পেছনে বেশি খরচ হয়। একটি জারবেরা শেড তৈরি করতে ছায়া দরকার। দরকার পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের। পোকামাকড় থেকে রক্ষা ও সরাসরি রোদ থেকে দূরে রাখতে আমদানি করা বিশেষ এক ধরনের পলিথিন দিয়ে শেড তৈরি করতে হয়। ফুল ফোটার পর গাছেই একটি ফুল অন্তত ৩০ দিন সতেজ থাকে। আর তা দীর্ঘায়িত লম্বা স্টিক বা ডাঁটার কিছু অংশ পানিতে ডুবিয়ে রাখলে আট থেকে ১৫ দিন সতেজ থাকে।
নাসির হোসেন বলেন, ৬০ লাখ টাকা দিয়ে তিন বছর আগে ছয় বিঘা জমিতে হলুদ, সাদা, লাল, খয়েরি, কমলা, ফিরোজা, মিষ্টি গোলাপি, গোলাপি রঙসহ প্রায় ৯টি রঙ বা প্রজাতির জারবেরা ফুলের চাষ করি। প্রতিদিন তার বাগান থেকে প্রায় তিন হাজার ফুল সংগ্রহ করা হচ্ছে। সপ্তাহে অন্তত চারবার ফুল সংগ্রহের পর তা পলিথিন দিয়ে র‌্যাপিং ও বাক্সবন্দি করে রাজধানীর শাহবাগে পাইকারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাইকারি দরে এখন প্রতিটি ফুল বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে ১০ টাকায়। ফুলের দোকানে খুচরা বিক্রি হয় ১৫ থেকে ৩০ টাকায়। বিশেষ দিনগুলোয় চাহিদা বেশি থাকে, তখন দামও বেড়ে যায়।
একই এলাকার যৌথ বাগান মালিক আশরাফ মিয়া, ফারুক হোসেন ও কামাল হোসেন জানান, জারবেরা চাষ বেশ লাভজনক। এক বিঘা জমিতে সারা বছর ধান, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসল থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এ থেকে উৎপাদন খরচ বেরিয়ে গেলে কৃষকের হাতে লাভের পরিমাণ খুবই কম থাকে। কিন্তু জারবেরা চাষে সমপরিমাণ জমি থেকে খরচ বাদে পাওয়া যায় প্রায় পৌনে ছয় লাখ টাকা। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করা যায়। তারা প্রতি মাসে এ বাগান থেকে প্রায় ৫০ হাজার ফুল বিক্রি করেন। কোনো কোনো মাসে ৭৫ হাজারের বেশি ফুল বিক্রি করেন।
সাভার উপজেলা কৃষি অফিসার শহিদুল ইসলাম বলেন, জারবেরা সূর্যমুখী প্রজাতির। ফুলটি দেখতে সূর্যমুখীর মতোই। এর নান্দনিক সৌন্দর্য ফুলের জগতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে ৯টি রঙের জারবেরার জাত আছে। সাভারে ৪৫০ হেক্টর জমিতে গোলাপ, গ্ল্যাডিউলাসসহ অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি বর্তমানে প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে জারবেরা ফুলের চাষ হচ্ছে। জারবেরা চাষে পুরাতন ও নতুন উদ্যোক্তাদের উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্য সময় পূর্ণ সূর্যালোক জারবেরা চাষের জন্য উত্তম। সাধারণত শীতকালে তাড়াতাড়ি ফুল ফোটে। গাছের যত্নে তাপমাত্রা কখনও ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর উঠতে দেওয়া উচিত নয়। চারা লাগানোর কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে পচা জৈবসার, ইউরিয়াসহ কিছু রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। কাট ফ্লাওয়ার উৎপাদনের জন্য জমিতে ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার উঁচু ও এক থেকে দুই মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হয়। পরিচর্যা ও অন্যান্য কাজের সুবিধার জন্য দুই বেডের মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার জায়গা খালি রাখা উত্তম। জারবেরার রোগ-বালাই তুলনামূলক কম। তবুও সতর্ক থাকা উচিত। অর্থাৎ রোগবালাই থেকে দূরে থাকতে চারা লাগানোর আগে তৈরি করা বেডে রাসায়নিক ব্যবহার করে অথবা কালো পলিথিন দিয়ে এক সপ্তাহ ঢেকে রেখে মাটি শোধন করে নিলে মাটিবাহিত রোগবালাইয়ের প্রকোপ কমে।

ইমতিয়াজ উল ইসলাম