জনবল সংকটে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল

শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও : জনবল সংকটে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নতি হলেও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি এখোনো। মানসম্মত চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তার ও নার্স। রংপুর বিভাগের মধ্যে এইচএসএস স্কোরিংয়ে কয়েকবার প্রথম স্থান অধিকার করেছে হাসপাতাল‌টি।

তবে শিল্পক্ষেত্রে উন্নত জেলার তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এগিয়েছে জেলার আধুনিক সদর হসপাতাল । যার প্রমাণ মেলে ঠাকুরগাঁওসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলার চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দেখে। ১৯৮৭ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতাল। ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে এটি ১৮ শয্যার শিশু শয্যাসহ ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৮ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০ শয্যার ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে নতুন ১৫০ শয্যার সাত তলা ভবন উদ্বোধন করে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করেন এবং ১৮ শয্যার শিশু ওয়ার্ডটিকে উন্নিত করা হয় ৪৫ শয্যায়। কিন্তু সে অনুপাতে এখনও জনবল এখনও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম
খাচ্ছে ডাক্তার ও নার্সরা। জানা যায় যে,হাসপাতালে ১ম শ্রেনীর চিকিৎসকের ১৬ টি পদসহ অন্যান্য শ্রেনীর মোট ৫৬ টি পদ খালি রয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে যে প্রতিদিন ৬৫০ থেকে ৭৫০ রোগী ভর্তি থাকে। এর মধ্যে শুধু শিশু ওয়ার্ডেই ভর্তি থাকে ১৬০/২০০ জন শিশু রোগী। দিনে ও রাতে ঠান্ডা এমন আবহাওয়ায় বেড়েছে ডায়রিয়া শিশু রোগীর সংখ্যা। শয্যা সংকটে পড়ে অভিভাবকরা অধিকাংশ শিশু রোগী নিয়ে অবস্থান করছেন ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বারান্দা কিংবা মেঝেতে । এই সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান ভালো থাকায় জেলার পাঁচ উপজেলাসহ আশপাশের জেলা পঞ্চগড়, নিলফামারী ও দিনাজপুরের কিছু অংশের রোগীরা সেবা নিতে আসায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কাঙ্খিত সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।

পঞ্চগড়, নিলফামারী ও দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা জানান, রংপুর বা দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তুলনায় ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতাল কাছে হওয়ায় আমাদের এখানে ছুটে আসা। চিকিৎসার মান ভালো হওয়ায় শয্যা সংকটে পড়েও মেঝে কিংবা বারান্দায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। হাসপাতালটিতে শয্যা বাড়ানোর পাশাপাশি লোকবল বাড়ানোও জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন রোগীরা। হাসপাতালে মেডিসিন ,সার্জারী,গাইনী,কার্ডিওলোজি ও শিশু সেবার মান ভালো ও জনবান্ধব হওয়ায় রোগীরা এই হাসপাতালে ছুটে আসেন।

হাসপাতালে চিকিৎসানিতে আশা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার লোহাগাড়া এলাকার এক শিশু রোগীর মাতা মোছাঃ সাবিনা আক্তার জানান, হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীদের আন্তারিক ভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। তাই হাসপাতালটিতে সবসময় ভীড় থাকে। হাসপাতালে খাওয়া দাওয়া পরিচ্ছন্নতার দিকটাও বর্তমানে ভালো। এই হাসপাতালটিতে জনবল নিয়োগ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রুপান্তরিত হলে ভালো হত। তাহলে আমাদের এই এলাকার জটিল রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি এই এলাকার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন হত।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আশা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখানগর গ্রাসের বাসিন্দা মোছাঃ মনসুর আলী জানান, আমাদের এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান ভালো ,ডাক্তার ও নার্সরা চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরন করেন। করোনালীন সময়ে আমার মাকে আমি এই হাসপাতালে বর্তি করি।জরুরি বিভাগের ডাক্তার রোগীর অবস্থা বেগতীগ রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তারা জানান এই রোগীর রোগ পরীক্ষা নীরিক্ষা করার মতো মেশিন আমাদের হাসপাতালে নেই। পরে রংপুর নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মারা যায় আমার মা। তাই আমি মনে করি আশে পাশের কয়েকটি জেলার কেন্দ্র ও কম দুরত্ব ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল এই হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রপান্তর করলে সবচেয়ে ভালো হত। তাহলে আমাদের আমাদের চিকিৎসায় অভাবে মারা যেতে হত না। অনেক সময় দূর্ঘটনায় আহত অথবা বিবিন্ন জটিল রোগীদের নিয়ে রংপর বা দিনাজপুর নিয়ে যেতে যেতেই মারা যায়। আবার গরীব মানুষ জটিল রোগীদের অর্থ অভাবে দিনাজপুর বা রংপুরে নিয়ে যেতে পারে না ফলে অকালেই মৃত্যমুখে পতিত হয়। যা বড় হৃদয় বিদারক। তাই হাসপাতালটি দ্রুত মেডিকেল কলেজে রুপান্তরিত হলে এই জেলাসহ আশেপাশের গরীব মানুষ চিকিৎসাসেবার সুবিধা হত।

ভেলাজান এলাকার আমিরুল নামে এক ব্যক্তি জানান আমার বড় ভাইয়ের দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। রংপুর গিয়ে ডায়ালাইসিস করতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাললে যদি এই কিডনি ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়া চালু থাকত তাহলে আমাদের খরচ ও দূর্ভোগ অনেক কম হত। তাছাড়া হাসপাতালটিতে জনবলের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে রুপান্তর করলে খুব ভাল হত হত।

হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে ছেলের চিকিৎসা নিতে আশা বেবি আকতার এক নারী জানান, এখানকার চিকিৎসকেরা চিকিৎসার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। কিন্তু চিকিৎসকের পাশাপাশি শিশু ওয়ার্ডে আরো শয্যা বাড়ানো দরকার। এখানে এত রোগীর চাপ থাকে যে বারান্দা বা মেঝেতে বসে চিকিৎসা নিতে হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সা‌লের ডি‌সেম্বর মা‌সের হেলথ সিস্টেমস স্ট্রেনডিং (এইচএসএস) স্কো‌রের পর্যা‌লোচনা ক‌রা হয়। এ‌তে বি‌ভিন্ন সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়াতে এইচএসএস স্কোরিংয়ে আটবার প্রথম স্থান অর্জন করে। সেবা নিতে আসা রোগী শারমিন আক্তার জানান, আগের তুলনায় হাসপাতালটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সদর উপজেলার আখানগর এলাকার বাসিন্দা মেহেদি হোসেন বলেন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফি‌রোজ জামান জুয়েল হাসপাতালটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকলেও তিনি ও অন্যান্য চিকিৎসকগণ যেভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন তা প্রশংসনীয়।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক ডা. মো. রকিবুল আলম রোগীর চাপের কথা স্বীকার করে বলেন, হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নতি হলেও জনবল দেওয়া হয়নি। ফলে অতিরিক্ত চাপে পড়ে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেবার মান বাড়াতে হলে জনবল প্রয়োজন। তারপরও সাধ্যমত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতা‌লের ত্বত্তাবধায়ক ডা. মোহাঃ ফিরোজ জামান জুয়েল জানান, স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা জেনা‌রেল হাসপাতা‌লের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত চিকিৎসা দল নিয়ে কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই জেনা‌রেল হাসপাতাল‌ এইচএসএস স্কোরিংয়ে কয়েকবার প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এ ছাড়াও এই হাসপাতালে ২০টি ক‌রোনা আই‌সিও ও ১০‌টি জেনা‌রেল আইসিইউ বেড সংযোজন করা হয়েছে। একই স‌ঙ্গে পি‌সিআর ল‌্যা‌বসহ কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালুর প্রক্রিয়া র‌য়ে‌ছে ব‌লে জানান এই কর্মকর্তা। একই সাথে হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজে রুপান্তর করলে এই এলাকার মানুষেরা অনেক উপকৃত হবে।এখানে প্রতিদিনই অভিজ্ঞ ডাক্তারা রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে প্র্রতি শিফটে তিনজন করে নার্স প্রতিনিয়ত অসু¯্থ রোগীদের’ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আবার কোন কোন ওয়ার্ডে শয্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এতে অতিরিক্ত রোগীদের বারান্দা বা মেঝেতে করেই চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে আমাদের।

উত্তরের ঐতিহ্যবাহী জেলা ঠাকুরগাঁও। অতিতের এই ঐতিহ্যবাহী জেলাটি হারিয়ে ফেলেছে তাঁর পুরোনো সেই ঐতিহ্য। ব্রিট্রিশ আমলে একটু উন্নয়নের ঝলক লাগলেও বর্তমানে জেলাটির মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অনেক কিছুর অভাব রয়েছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য অন্যতম মৌলিক প্রধান চাহিদা হল চিকিৎসাসেবা।এই চিকিৎসাসেবার আধুনিকায়নের যুগে এই জেলায় প্রয়োজন একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যা জেলার মানষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে।বর্তমানে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয‌্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালকে ইতিমধ্যে মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে রুপান্তর করা ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৫ লক্ষ্য মানুষের জনদাবীতে পরিণত হয়েছে। মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে রুপান্তর করার জনদাবী নিয়ে ফুসে উঠেছে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ। ইতি মধ্যে ঠাকুরগাঁও সর্বস্তরের মানুষ মানব বন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। স্থানীয় এমপি জনাব রমেশ চন্দ্র সেন জানান ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয‌্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাটিকে শিগ্রই মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে রুপান্তর করা হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০