ড. শাহনাজ আরেফিন: জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক, সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও এবং সর্বোপরি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য আর্থসামাজিক, জনতাত্ত্বিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, স্থূল জাতীয় উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি, জাতীয় আয় নিরূপণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অফিশিয়াল পরিসংখ্যান প্রস্তুত, সংকলন ও প্রকাশের দায়িত্ব নিয়মিতভাবে পালন করে আসছে। বিবিএস কর্তৃক পরিচালিত শুমারিগুলোর মধ্যে জনশুমারি ও গৃহগণনা দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম।
জনশুমারি ও গৃহগণনা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পরিচালিত ব্যাপকভিত্তিক পরিসংখ্যানিক কার্যক্রম। ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান আইন প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত এ শুমারিটি ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনা’ নামে পরিচতি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম। আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে ১০ বছর পর্যাবৃত্তি অনুসরণপূর্বক দেশের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা। যথাক্রমে ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও কভিড-১৯ মহামারির কারণে তা আগামী ১৫-২১ জুন, ২০২২ সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর মাধ্যমে মূলত দেশের প্রতিটি গৃহ, খানা ও ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হবে। শুমারির সামগ্রিক কার্যক্রম ৪টি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হবে, যথা: শুমরির প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড মূল শুমারি পরিচালনা শুমারি পরবর্তী যাচাই জরিপ (পিইসি) পরিচালনা এবং আর্থসামাজিক ও জনতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স তারিখে প্রতিটি খানা ও খানার সদস্যগণকে গণনার অন্তর্ভুক্ত করে দেশের মোট জনসংখ্যার হিসাব নিরূপণ; ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার নিমিত্ত বেঞ্চমার্ক তথ্য সংগ্রহ করা; সব ধরনের খানাভিত্তিক আর্থসামজিক জরিপের জন্য নমুনা ফ্রেম (Integrated Multi-Purpose Sample – IMPS) প্রস্তুত করা; জেলাভিত্তিক জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ (Population Projection) করা; স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য তথ্য সরবরাহ করা; জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য সরবরাহ করা।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাবেষ্টিত অঞ্চলের সকল গৃহ, সাধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ও বস্তি খানা, ভাসমান জনগোষ্ঠী, খানায় বসবাসরত সকল সদস্যের জনমিতিক ও আর্থসামাজিক তথ্য, যেমনÑগৃহের সংখ্যা ও ধরন, বাসস্থানের মালিকানা, খাবার পানির প্রধান উৎস, টয়লেটের সুবিধা, বিদ্যুৎ সুবিধা, রান্নার জ্বালানির প্রধান উৎস, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বৈদেশিক রেমিট্যান্স, খানা সদস্যদের বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, প্রতিবন্ধিতা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার, ব্যাংক/মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জাতীয়তা, নিজ জেলা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
এবারের শুমারিতে ‡IS (‡eographic Information System) ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার করে CAPI (Computer Assisted Personal Interviewing) পদ্ধতিতে ডিজিটাল ডিভাইস ‘ট্যাবলেট’-এর মাধ্যমে একযোগে দেশের সকল খানা, গৃহ ও জনসাধারণের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। মাঠপর্যায়ে মূল শুমারির তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম আগামী ১৫-২১ জুন, ২০২২ সময়ে পরিচালিত হবে। ওই সময়ে সাময়িকভাবে নিযুক্ত তথ্যসংগ্রহকারী (প্রায় ৩.৭০ লাখ) যারা স্থানীয় শিক্ষিত যুবক/যুব মহিলা প্রতিটি খানা ও জনসাধারণের তথ্য ট্যাবলেটের মাধ্যমে সংগ্রহ করবে। ডিজিটাল এ শুমারি বাস্তবায়নে সারাদেশে একযোগে তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হবে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাবলেট। এর পাশাপাশি IT Infrastructure †hgb: CAPI Apps, যেমন: ঈঅচও অঢ়ঢ়ং, ক্লাউড সার্ভার, ওরাকল এক্সাডাটা সার্ভার, লোড ব্যালেন্সার, ১০ নেঢ়ং ইন্টারনেট, ফাইবার অপটিক্যাল কেব্ল ইত্যাদি প্রস্তুত ও ইনস্টল করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত ট্যাবলেটসমূহ MDM (Mobile Device Management) software বহার করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এছাড়া মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) ) TIER IV Security সমৃদ্ধ ডেটা সেন্টার ব্যবহার করা হবে। মাঠপর্যায় থেকে বিডিসিসিএল হয়ে বিবিএস সার্ভারে ডেটা আসার পূর্ব পর্যন্ত সকল পর্যায়ে ডেটা encrypted অবস্থায় থাকবে, যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা হচ্ছে। শুমারির তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের অগ্রগতি মনিটর করার জন্য শুমারি পর্যবেক্ষণ অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দৈনন্দিন তথ্য সংগ্রহের পরিমাণ যেকোনো পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করা যাবে, যা নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। সর্বোপরি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ফলে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ সহজতর হবে এবং স্বল্পতম সময়ে শুমারির রিপোর্ট প্রকাশ সম্ভব হবে। শুমারি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা, সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণ, তথ্য-?উপাত্ত ব্যবস্থাপনা ও প্রকাশের জন্য একটি ওয়েবভিত্তিক Integrated Census Management System (ICMS) প্রস্তুত করা হয়েছে। শুমারি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পুরো দেশকে ১৬৩টি শুমারি জেলা, ৩৮০১টি জোন ও ৩,৮০,৯৪৫টি গণনা এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এ শুমারিতে প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে প্রতিটি প্রশাসনিক এলাকা ও গণনা এলকার জন্য ডিজিটাল ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুমারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ওয়েববেজড জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করে শুমারির সব প্রশাসনিক স্তরের তথ্য স্বল্পতম সময়ে প্রকাশ ও প্রদর্শন করা সম্ভব হবে।
প্রায় প্রতিটি গণনা এলাকার জন্য স্থানীয় শিক্ষিত যুবক/যুব মহিলাগণের মধ্য থেকে ০১ (এক) জন গণনাকারী এবং ৫/৬ জন গণনাকারীর জন্য ০১ (এক) জন সুপারভাইজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গণনাকারী ও সুপারভাইজারদের (গড়ে ১২০ জন) কার্যক্রম তদারকির জন্য ০১ (এক) জন জোনাল অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যারা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য দপ্তরের নিয়মিত কর্মচারী। জোনাল অফিসারদের কার্যক্রম তদারকির জন্য উপজেলা শুমারি সমন্বয়কারী, উপজেলা শুমারি সমন্বয়কারীর কার্যক্রম তদারকির জন্য জেলা শুমারি সমন্বয়কারী, জেলা শুমারি সমন্বয়কারীর কার্যক্রম তদারকির জন্য বিভাগীয় শুমারি সমন্বয়কারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সকল পর্যায়ের সমন্বয়কারীরা বিবিএসের সদর দপ্তর ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা। অর্থাৎ শুমারির গুণগতমান নিশ্চিতকল্পে ০৬ স্তরবিশিষ্ট মনিটরিং কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গণনাকারী থেকে বিভাগীয় শুমারি সমন্বয়কারী পর্যন্ত সকলের জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক ‡IS (‡eographic Information System) বেইজড ডিজিটাল ম্যাপ ইতোমধ্যে প্রস্তুত ও সরবরাহ করা হয়েছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এ দেশের সকল জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০২২ সালের ৭ জুন শুমারির স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেছেন। শুমারির প্রাক্কালে যে কোনো সুবিধাজনক সময়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করবেন, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্র্রচার করা হবে। শুমারির প্রথম দিন জাতীয় দৈনিকসমূহে এতদ্বিষয়ক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। প্রচারের অংশ হিসেবে TV ¯Œwjs, TVC (Television Commercial), RDC (Radio Commercial), PSA (Public Service Announcement), ডকুড্রামা, জিঙ্গেল ইত্যাদি টেলিভিশন ও বেতারে সম্প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকারে নিয়মিত প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রথাগতভাবে র?্যালি, মাইকিং, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই শুমারিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর/সংস্থা, অধিদপ্তরের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন (বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন) ও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সফলভাবে সম্পন্ন হলে বিগত ১০ বছরে জনসংখ্যা ও দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠবে, যা পরবর্তী ১০ বছরের যে কোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পিআইডি নিবন্ধ