Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 5:36 am

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন

মো. হাবিবে মিল্লাত: সম্প্রতি বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পুনঃসংশোধনের অংশ হিসেবে, খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে এই খসড়া আইনে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে আমি একমত পোষণ করছি। পাশাপাশি, এসব প্রস্তাবের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় যে ইতোমধ্যে আদা জল খেয়ে লেগেছে সেটিও খেয়াল করেছি। তারই অংশ হিসেবে লক্ষ করলাম, ই-সিগারেট বা ভেপিং ব্যবসায়ীরা এই নতুন ধরনের ক্ষতিকর হিটেড টোব্যাকো কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে সে ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যা সত্যিই হতাশাজনক। 

প্রশ্ন উঠেছে, তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে কেন ই-সিগারেট বা ভেপিংকে যুক্ত করা হয়েছে। বিস্তারিত তুলে ধরার আগে একটি কথা না বললেই নয়। এই আইন সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। সেই সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। ভেপ বা ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে তিনি বিভিন্ন ফোরামে বলে এসেছেন এবং এখনও বলছেন, তার সময়ে এই পণ্যের ততটা প্রচলন ছিল না বলেই এটাকে তিনি আইনের আওতায় আনতে পারেননি। যে কারণে প্রচলিত সিগারেট, বিড়ি, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে এই ভেপিং বন্ধে এবং এটাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে তিনি অত্যন্ত সরব। সেই ধারাবাহিকতায়, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিংয়ের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিই। যার ফলাফল, প্রধানমন্ত্রীর নিকট তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও ই-সিগারেট নিষিদ্ধের দাবিতে চিঠির মাধ্যমে ১৫৩ জন সংসদ সদস্যদের সুপারিশ।  

এনটিসিসি’র খসড়া প্রস্তাবে ভেপিং সম্পর্কে বলা হয়েছেÑইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম,  প্রভৃতি নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, উহার যন্ত্রাংশ বা অংশবিশেষ (ই-সিগারেট, ভেপ, ভেপিং, ভ্যাপার প্রভৃতি) হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টস, হিট নট বার্ন এবং ওরাল পাউচ যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, তার উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করিবেন না বা করাইবেন না।

দেশে তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো শক্তিশালী, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেন্ডস্টা) নামক সংস্থাটি ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে সংবাদ সম্মেলন করেছে। যেখানে এই আইন থেকে এ পণ্যটি সরিয়ে নেয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি, কেন ই-সিগারেট ভালো; সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে হাস্যকর যে দাবি তা হলো, কেন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে এই হিটেড টোব্যাকোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সবাই জানেন, বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৭ শতাংশ ঘটে হƒদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, শ্বাসরোগ, কিডনি রোগ এবং স্ট্রোকের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে। একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, তামাক বা তামাকজাত পণ্য ও নতুন ধরনের হিটেড টোব্যাকো (ই-সিগারেট ও ভেপিং) কীভাবে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। দেশের সবার জন্য, সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) নিশ্চিত করার আন্দোলন হিসেবে আমরা দীর্ঘদিন  তামাক ও মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছি। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এই কাজ করতে গিয়ে আমি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। নিঃসন্দেহে এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই কাজ করতে গিয়ে বিষয়গুলো বৃত্তের বাইরে থেকে দেখার ও ভাবার চেষ্টা করেছি। 

ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক নিয়ে যেসব সংস্থা গবেষণা করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন। তাদের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ই-সিগারেটে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত। কণ্ঠনালি ও হƒদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ৫৯ ও ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ই-সিগারেটের মূল ক্ষতিকর উপাদানের ফ্লেভারিং এজেন্ট। এছাড়া রয়েছে নিকোটিন, প্রপাইলিন গ্লাইকল যা শ্বাসতন্ত্র, লিভার ও কিডনি রোগের কারণ হয়। রয়েছে কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ, যা ক্যানসারের প্রভাবক হতে পারে। এই পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাবের হাত থেকে জনসাধারণকে বাঁচাতে, ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ মোট ৩৩টি দেশে ই-সিগারেট বা ভেপিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে কারণেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা জরুরি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের বাংলাদেশ ২০১৭ প্রতিবেদন অনুসারে, ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কই ই-সিগারেটের বিষয়ে অবগত, দশমিক ৪ শতাংশ কখনও ব্যবহার করেছেন এবং দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহার করেছেন। 

ই-সিগারেটের প্রচারণা ক্যাম্পেইন করা হয় তরুণদের টার্গেট করে। যদিও বয়স্ক ব্যক্তি; যারা ধূমপান ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন তারাও ই-সিগারেটকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকে। আদতে ই-সিগারেট বা ভেপ; যেটাই বলি না কেন তা তামাকের সিগারেটেরই অন্যরূপ। এতে অ্যাক্রোলিন, নিকেল, ক্রোমিয়াম বা সিসার মতো প্রায় মোট ৮০টি উপাদান থাকে, যা সরাসরি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এর আল্ট্রাসনিক নিকোটিন ফুসফুসের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এগুলো গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর জন্যও সমান ক্ষতিকর। দোকানের পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর মুখরোচক বিজ্ঞাপন এবং অনলাইনে এর দেদার বিকিকিনি তরুণ প্রজšে§র জন্য শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, বরং তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নকেও পিছিয়ে দিতে পারে। সে কারণেই আমরা তামাকবিরোধী সব পক্ষকে একসঙ্গে নিয়ে প্রচলিত সিগারেট বা বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাতপণ্যে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এই নতুন ধরনের ‘তামাক’ পণ্যের আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন নিষিদ্ধের সুপারিশ জানিয়ে আসছি।

বিভিন্ন তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই তামাপণ্যের মধ্যে যেমন বিড়ি, সিগারেট, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য দায়ী; তেমনই দায় রয়েছে ভেপিংয়ের মতো হিটেড টোব্যাকোরও। তাই প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভেপ ও ই-সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষেই থাকতে চাই।

সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান

বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর

হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং