জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক ব্যবসা থেকে সরকারের অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করা জরুরি

সাইফুদ্দিন আহমেদ: ২০১১ সাল থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যরত সংগঠনগুলো ‘জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস’ পালন করে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক ব্যবসা থেকে সরকারের অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করা হোক’। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম শুরু হয়েছে আশির দশকে। ২০০৩ সাল আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর এবং ২০০৪ সালে অনুসমর্থন করেছে। এফসিটিসির আলোকে ২০০৫ সালে দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রণয়ন করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন।

আইন প্রণয়নের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক আরও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান। যে কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হয়নি। আশ্চর্য হলেও সত্যি নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) তে বাংলাদেশ সরকারের শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ অংশীদারিত্ব বা শেয়ার রয়েছে। সামান্য শেয়ারের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বিএটির বোর্ড অব ডিরেক্টরিতে যুক্ত থাকছেন। জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, পরিবেশ ও অর্থনীতি খাতে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ও কোম্পানির আগ্রাসী কার্যক্রম বন্ধে অনতিবিলম্বে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি।

তামাক কোম্পানিগুলো নীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য যেসব কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়ক কৌশল সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রম (সিএসআর)। সিএসআর এর আড়ালে কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে নানাভাবে নিজেদের অবস্থানকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে তামাক ব্যবসা সম্প্রসারণে সম্পৃক্ত করতে চায়। করোনা মহামারি চলাকালে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। কোম্পানিতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব থাকার করোনাকালীন সব উৎপাদনমুখী সেক্টরগুলো বন্ধ থাকলেও শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে কঠোর লকডাউনের সময়েও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও বিপণন অব্যাহত রেখেছিল। একইসঙ্গে আইন লঙ্ঘন করে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণাও চালিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। করোনাকালীন প্রেরণা ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে সরকারি অফিসগুলোয় হ্যান্ড সেনিটাইজার, মাস্ক, পিপি বিতরণ করতে দেখা গেছে। তামাক ব্যবহারকারীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি হলেও সে বিষয়টি নানাভাবে আড়াল করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে তামাক কোম্পানিগুলো মহামারির সংকটের সুযোগ নিয়ে সিএসআরের নামে আগ্রাসীভাবে ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে।

নামমাত্র কিছু লোককে ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশনে সহায়তা, পিপিই, হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রদানসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সান্নিধ্যে এসে ভবিষ্যতে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের হস্তক্ষেপের পথ সুগম করার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন স্থানে ‘বনায়ন’ কর্মসূচির নামে বৃক্ষরোপণ, পানির কল স্থাপনের নামে ‘প্রবাহ’-এর মতো প্রতারণামূলক সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাংবিধানিকভাবে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকার সর্বদা বদ্ধপরিকর। তামাক কোম্পানিতে সামান্য সরকারি শেয়ার থাকায় লাভবান হচ্ছে কোম্পানি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার ও জনগণ। ‘তামাক’ জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর পণ্য, এটি সর্বজনস্বীকৃত। গবেষণায় দেখা যায়, সিগারেটে ৭ হাজারের অধিক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা ক্যানসার, হূদ্রোগ, স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন: হাঁপানি, অ্যাজমা, সিওপিডিসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগের জন্য সরাসরি দায়ী। এছাড়া বিড়ি, হুক্কা এবং ধোঁয়াবিহীন বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্য সমানভাবে জনস্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

তামাক কোম্পানির স্বার্থ মুনাফা অর্জন এবং সরকারের স্বার্থ জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন। পারস্পারিক সাংঘর্ষিক স্বার্থ নিয়ে স্বাস্থ্যহানিকর তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরকারের শেয়ার কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এফসিটিসি এর আর্টিক্যাল ৫.৩ এর গাইডলাইন ৭.২ এ সুপারিশ করা হয়েছে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোকে তামাক ব্যবসায় বিনিয়োগ না করার জন্য। সমগ্র বিশ্বের জন্য তামাককে উন্নয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এ স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক ৩নং অভীষ্টে এফসিটিসির কার্যকর বাস্তবায়ন ও অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যু ৩ ভাগের ১ ভাগ কমানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং সেবন প্রতিটি ধাপেই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির মারাত্নক ক্ষতি সাধন করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং এসডিজির অভীষ্ট অর্জন করতে হলে তামাক কোম্পানিতে বাংলাদেশ সরকারের অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার অপরিহার্য।

দেশের তরুণ-তরুণীরা তামাক কোম্পানিগুলোর মূল টার্গেট। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ তরুণ। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ কর্মক্ষম জনসংখ্যা হবে ৭০ শতাংশ। সুস্থ-সবল জনশক্তি ও নির্মল পরিবেশ জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এজন্যই আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সবল হিসেবে গড়ে তুলতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অতএব তামাকমুক্ত দেশ গড়তে এই ব্যবসায় সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করা এখন সময়ের দাবি।

তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে সেই ‘তামাক’ ব্যবসায় অংশীদারিত্ব এবং কোম্পানিতে সরকারের প্রতিনিধি থাকায় জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিগত দিনে আমরা দেখতে পেয়েছি তামাক কোম্পানিগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপের ফলে জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক আইন ও নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় বিগত সময়ে দেশে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ এর বিধিমালায় তামাক কোম্পানির পক্ষে বিধান যুক্ত করা হয়। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের নির্দিষ্ট সময় ১৮ মাস দীর্ঘায়িত করা হয় এবং আইনে উপরিভাগে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করার উল্লেখ থাকলেও তা নিম্নাংশে আসে। তামাক কোম্পানির নিজস্ব তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বিগত দিনে কোম্পানিগুলো সরকারকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন, আইন সংশোধন, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান এমনকি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। নীতিতে প্রভাব বিস্তার, রাজস্ব ফাঁকি, অনৈতিক সুবিধা আদায় এবং বিভিন্নভাবে সরকারকে চাপ প্রয়োগের ঘটনাও নতুন নয়। ২০১৭ সালে বিএটি’বি ১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় কর ফাঁকির ঘটনা বেআইনি প্রক্রিয়ায় সমঝোতা করতে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার অর্থমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন।

বিভিন্ন কোম্পানিতে বাংলাদেশ সরকারের শেয়ার রয়েছে। ইউনিলিভার বাংলাদেশ, নোভারটিস, সিনজেনটার মতো বহুজাতিক কোম্পানিতে বিএটিবি’র চাইতে অনেক বেশি শেয়ার থাকলেও তাদের পরিচালনা পর্ষদে বিএটিবি’র মতো এত বেশি সংখ্যক সরকারি প্রতিনিধি সম্পৃক্ত নেই। তামাক খাতে সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা ব্যয় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, তার বিপরীতে রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এ রকম জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর ও অলাভজনক পণ্য উৎপাদনকারী খাতে সরকারের অংশীদারিত্ব বা শেয়ার রাখা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

এফসিটিসি অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তামাক কোম্পানির প্রভাব থেকে নীতি সুরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার বৈশ্বিকভাবেও বিষয়টি আমলে নেয়া হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তামাক কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে। ইতোমধ্যে সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি, নিউসাউথ ওয়েলস এবং সাউথ অস্ট্রেলিয়া, সেইসঙ্গে মেলবোর্ন সিটি তামাক শিল্প থেকে তাদের পাবলিক বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে নতুন সরকার এসেছে। জনকল্যাণে তারা নানা বিষয় সংস্কার করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তামাক কোম্পানিতে বাংলাদেশ সরকারের যে অংশীদারিত্ব রয়েছে তা প্রত্যাহারের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখন থেকেই সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০