Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:00 pm

জমিদারবাড়িতে একদিন

সবুজে ঘেরা তাজহাট জমিদারবাড়ি রংপুরের প্রাঙ্গণ। প্রতিদিন এ জাদুঘরে ভিড় জমে কয়েকশ দর্শনার্থীর। নিদর্শন উপস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা থাকলেও কাছাকাছি অন্য কোনো হেরিটেজ সাইট না থাকায় এখানে দিন দিন বাড়ছে দর্শনার্থীর আনাগোনা। রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি ঘুরে এসে জানাচ্ছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ

রংপুর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্বে তাজহাটের ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই জমিদারবাড়ি। পূর্বমুখী দোতলা বিশাল রাজপ্রাসাদটির দৈর্র্ঘ্য ৭৬ দশমিক ২০ মিটার। বিদেশ থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি ১৫ দশমিক ২৪ মিটার প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গেছে। আট কোণাবিশিষ্ট ড্রামের ওপর স্থাপিত গম্বুজ প্রাসাদের মাঝ বরাবর ছাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সিঁড়ির উভয় পাশে দোতলা পর্যন্ত ইতালীয় মার্বেলের ধ্রুপদি রোমান দেব-দেবীর মূর্তি দ্বারা সজ্জিত ছিল। সেগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। প্রাসাদের সম্মুখভাগের দুই প্রান্ত সেমি-আটকোণা ও মধ্যভাগে একটি ৯.১৪ মিটার বারান্দা। ওই বারান্দার ছাদের উপরে চারটি সুসজ্জিত কোরিন্থীয় স্তম্ভ এবং চালবিশিষ্ট দুটি কক্ষ আছে। প্রাসাদটির ভূমি নকশা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো, যার পশ্চিম দিক উন্মক্ত। প্রাসাদের নিচতলায় প্রবেশপথের পেছনে  ১৮ দশমিক ২৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৩ দশমিক ৭২ মিটার প্রস্থের একটি হলঘর রয়েছে। প্রাসাদ অভ্যন্তরের পুরোভাগজুড়ে তিন মিটার প্রশস্ত বারান্দা। তাছাড়া উপরতলায় ওঠার জন্য প্রাসাদে কাঠের দুটি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি দুটির একটি উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে, অপরটি পূর্ব বাহুর দক্ষিণ প্রান্তে। এ প্রাসাদে সব মিলিয়ে ২২টি কক্ষ আছে। প্রাসাদের সামনে রয়েছে সবুজ গাছগাছালি আর শান বাঁধানো তিনটি পুকুর।

জমিদার আমলে রংপুর অঞ্চলের তাজহাট, ডিমলা, কাকিনা, মহুনা, পীরগঞ্জ ও বর্ধনকোট এলাকায় স্বনামখ্যাত জমিদার বংশ ছিল। সে সুবাদে উত্তরাঞ্চলজুড়েই রয়েছে সুরম্য জমিদারবাড়ি। অন্য সবগুলোকে ছাপিয়ে তাজহাট জমিদারবাড়ি উত্তর জনপদের অন্যতম দর্শনীয় স্থানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা মান্নালাল রায় শিখ বংশে জন্ম ছিলেন। পরবর্তীতে ধর্মান্তরের পর রংপুরের তৎকালীন জেলা সদর মাহিগঞ্জে আসেন। সেখানে এসে স্বর্ণের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের জেরে জীবদ্দশায় বিপুল সম্পত্তির মালিক হন তিনি। স্বর্ণকার মান্নালাল রায়ের ব্যবহৃত স্বর্ণখচিত ‘তাজ’ বা মুকুটের কারণেই ওই এলাকার নামকরণ হয় ‘তাজহাট’। তার নাতি ধনপত রায় পাঞ্জাবের আরেক সম্পদশালী রতনলাল রায়ের নাতনিকে বিয়ে করেন। এরপর রতনলাল রায়ও পাঞ্জাব ছেড়ে এদেশে চলে আসেন। ধনপত রায়ের পরবর্তী বংশধর তার নাতি উপেন্দ্রনাথ রায় অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় ‘মুনসেফ’ হিসেবে জমিদারির দায়িত্ব নেন ধনপত রায়ের চাচা গিরিধারী লাল রায়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতার গোবিন্দলালকে দত্তক নেন।

১৮৭৯ সালে গোবিন্দলাল তাজহাট জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। তার জনপ্রিয়তাও ছিল উল্লেখ করার মতো। যে কারণে ১৮৮৫ সালে ‘রাজা’ উপাধি পান। এর সাত বছর পরই ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধি পান। ১৮৯৬ সালে ‘মহারাজা’ উপাধি গ্রহণের এক বছর পরই ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০৮ সালে গোবিন্দলালের ছেলে মহারাজা গোপাল কুমারলাল রায় জমিদারির দায়িত্ব নেন। তার হাতেই বর্তমান জমিদারির তিভ রচিত হয়েছিল।

১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রত্তনত্ত্ব অধিদফতর ইমারতটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। ওই প্রাসাদের অনন্য স্থাপত্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০০২ সালে শহর থেকে তাজহাটে রংপুর জাদুঘর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ওই প্রাসাদের অংশবিশেষ ‘রংপুর জাদুঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই জাদুঘরে শতবছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবান অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। সংরক্ষিত উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে আরবি শিলালিপি, বেলেপাথর বাংলা শিলালিপি, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, বল্লম, পোড়ামাটির পাত্র, ফটক, পোড়া ময়ূর, উনবিংশ শতাব্দীতে পাওয়া পিতলের দুর্গা, শিবলিঙ্গ, পাথরের মূর্তি, উল্কাপিণ্ড, জমিদারদের পুরনো আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি ও কালো পাথরের খোদাই করা সংস্কৃত শিলালিপি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের স্বহস্তে লেখা চিঠি, তুলট কাগজ, সংস্কৃত হস্তলিপি এবং ফারসি কবিতাও সেখানে স্থান পেয়েছে। এসব কারণে পিকনিক স্পট হিসেবে দর্শনার্থীদের পছন্দের শীর্ষে এই জমিদারবাড়ি।

জাদুঘরের প্রবেশমুখে ডান পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি টিকিটের দাম ২০ টাকা। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য টিকিটের দরকার হয় না। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিশু-কিশোরের জন্য প্রবেশমূল্য পাঁচ টাকা করে। এছাড়া সার্কভুক্ত বিদেশি দর্শনার্থীদের প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা, যা বিদেশি অন্য দর্শনার্থীদের ২০০ টাকা। গ্র্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ও শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রোববার সাধারণ ছুটি ও সোমবার দুপুর ২টা থেকে খোলা থাকে। এছাড়া সরকারি বিশেষ ছুটিতেও ওই জাদুঘর বন্ধ থাকে।