ওটিসি মার্কেট

জমি যন্ত্রপাতি সম্পদ বিক্রি করে‘কাগুজে’ আশরাফ টেক্সটাইল

বিনিয়োগকারীদের কাছে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেট মানেই পদে পদে ভোগান্তি। এতে একসময় কোম্পানির খোঁজ-খবর নেওয়া বন্ধ করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাও কোম্পানিগুলোর খোঁজ রাখেন না। যে কারণে সবার অগোচরে কোম্পানিগুলোতে চলে নানা অনিয়ম। তেমনই কিছু কোম্পানি পরিদর্শনকালে পাওয়া তথ্য নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

পলাশ শরিফ: উৎপাদনে না থাকা ও নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করাসহ বিদ্যমান সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আশরাফ টেক্সটাইলকে মূল মার্কেট থেকে সরিয়ে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে পাঠায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে বিতর্কিত কোম্পানিটি। সে সুযোগ নিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানিটির যন্ত্রপাতি-সম্পদ বিক্রি করে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে জটিলতায় পড়ছে আশরাফ টেক্সটাইল। সব বিতর্ক কাটিয়ে কোম্পানিটির মূল মার্কেটে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের টঙ্গী আশরাফাবাদ (টঙ্গী বাজার) এলাকায় প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত আশরাফ টেক্সটাইল। এর মধ্যে প্রায় আড়াই বিঘা জমিতে স্কুল ও মসজিদ রয়েছে। এর বাইরে কারখানা, অফিস-গোড়াউন ছিল প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপর। আর কারখানার সামনে প্রায় সাত বিঘা জমিতে ছিল পুকুর।

কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনকালে বাস্তবে সেখানে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। স্কুল-মসজিদের সন্ধান মিললেও বাকি জমিতে অবকাঠামোর সন্ধান মেলেনি। কারখানার সামনেও পুকুর নেই। ভরাট করে সেখানে ‘আশরাফ-সেতু কমপ্লেক্স’ নামে ১১ তলাবিশিষ্ট বহুতল বাণিজ্যিক-আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ দোতলা বেজমেন্টসহ পাঁচতলা বাণিজ্যিক ভবনের কাজ শেষ হয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী, ওই পাঁচতলা ভবনের মালিক এখন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হাজী শামসুল হক। নিজ খরচে ভবন নির্মাণসাপেক্ষে পরবর্তী ছয়তলার মালিক আশরাফ টেক্সটাইল।

এদিকে আশরাফ টেক্সটাইলের বাকি প্রায় ৪২ বিঘা জমি ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে দু’দফায় বেসরকারি কোম্পানি কর্ণফুলী লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলীর স্বত্বাধিকারী সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। পরবর্তীকালে কর্ণফুলীর কাছ থেকে প্রায় ১৯ বিঘা জমি কিনেছে ‘নান্দোস’ নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ আশরাফ টেক্সটাইল বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকায় এভাবে কারখানার যন্ত্রপাতি, জমি বিক্রি ও পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ নেই। তারপরও স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু লোক ও শ্রমিক ইউনিয়নের কথিত নেতাদের সহায়তায় কোম্পানিটির পরিচালকরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমি-যন্ত্রপাতিÑসবকিছু বিক্রি করে দিয়েছেন বলে তথ্য মিলেছে।     

ওটিসিতে নজরদারি না থাকার সুযোগে এক দশকে আশরাফ টেক্সটাইলের সিংহভাগ জমি বেসরকারি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কর্ণফুলীর কাছে প্রায় ৪২ বিঘা জমি ১০০ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও কোম্পানির উদ্যোক্তারা ৮০ কোটি টাকায় বিক্রির কথা বলছেন। আর ডিএসইতে দেওয়া হিসাবে জমি বিক্রি করে প্রায় ৬৭ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে আশরাফ টেক্সটাইল। সে সঙ্গে কারখানার পুকুর ভরাট করে সেখানে বহুতল শপিং কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হচ্ছে। 

সূত্র জানায়, কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ যন্ত্রপাতি-জমি বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু এভাবে ওই কোম্পানির কোনো কিছু বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। সে সঙ্গে ভবন নির্মাণের বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আশরাফ টেক্সটাইলের সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যন্ত্রপাতি-জমি বিক্রি, পুকুর ভরাট ও বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে আশরাফ টেক্সটাইলের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পর অনিয়ম খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করেছে বিটিএমসি। তদন্ত শেষে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিটিএমটির দায়িত্বশীলরা।

জমি ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে কর্ণফুলী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার জন্য কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি। পরে কোম্পানিটির জিডিএম জহির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা যথাযথ নিয়ম-কানুন মেনেই জমি কিনেছি। সেখানে কারখানা স্থাপন করেছি। এখানে বিটিএমসির কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না কিংবা ওই মিলের মালিক বিটিএমসি কি নাÑসে বিষয়ে বিটিএমসি থেকে কিছু জানানো হয়নি। বিটিএমসি কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। জমি ক্রয় প্রক্রিয়ায় কোনো অসংগতি নেই।’

আশরাফ টেক্সটাইলের পরিচালক আবদুল আজিজ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে আমরা বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে এখন বিএসইসির অধীনে চলে গেছি। সুতরাং, এখানে মন্ত্রণালয় বা বিটিএমসির কিছু বলার নেই। আমরা গাজীপুরের মাওনায় জমি কেনার কথা বলেছি। কিন্তু এখনও কিনিনি। তবে বাকি জমি বিক্রি হলে কিনব। ওই জমি বিক্রির টাকায় দায়দেনা পরিশোধ করেছি। এসব বিষয়ে বিটিএমসিসহ সবার কাছে আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি। তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। এখন বিটিএমসি যা করছে, করুক। সেটি তাদের ব্যাপার। তবে আপনি এসব নিয়ে কিছু লেখার আগে একটু চিন্তা-ভাবনা করে লিখবেন।’

কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ আলী মৃধা বলেন, ‘আপনার যা ইচ্ছা লেখেন। ব্যাখ্যা আমাদের কাছে আছে। লিখিত প্রশ্ন ছাড়া আমরা আর এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। সরকারি কোনো দপ্তর থেকে কোনো কিছু জানতে চাওয়া হলে তখন সে অনুযায়ী জবাব দেওয়া হবে।’ উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে মিলটি ‘আশরাফ কটন মিলস’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কোম্পানি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) পথচলা শুরুর পর থেকে আশরাফ টেক্সটাইলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যায়। দায়দেনা পরিশোধ, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও উৎপাদন চালু রাখার শর্তে ১৯৮৩ সালে আশরাফ টেক্সটাইল পূর্বের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর ব্যবসায়িকভাবে ভালো অবস্থানেও যায় কোম্পানিটি। ইউনিটের সংখ্যা তিনটি থেকে ছয়টিতে পৌঁছায়। এর জেরে ওই কোম্পানিতে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের জেরে ২০০৪ সালে এসে লোকসানের কারণ দেখিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ২০০৬ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ করা হয়। গাজীপুরে নতুন কারখানা করা হবে জানিয়ে কারখানার যন্ত্রপাতি অন্য পোশাক উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সে সঙ্গে ব্যাংকের ঋণসহ অন্য দায়দেনা পরিশোধের কথা বলে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা আটকে দেওয়া হয়। এখনও শ্রমিকদের প্রায় ৫০ লাখ টাকা বকেয়া বেতন-ভাতা রয়ে গেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০