জাকারিয়া পলাশ: প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকদের মিলনমেলায় জমজমাট এখন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গতকাল ছিল মেলার তৃতীয় শুক্রবার। এ দিন মেলা প্রাঙ্গণ ছিল লোকারণ্য। বিক্রিবাট্টাও বেড়েছে। তবে বইয়ের মূল্য অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বলে অভিযোগ করছেন ক্রেতারা। অবশ্য লেখক-প্রকাশকরা বলেছেন ভিন্ন কথা।
ক্রেতাদের অভিযোগ, অনেক প্রকাশনীতেই বইয়ের ছাপা, কাগজের মান ও বাঁধাই নি¤œমানের। কিন্তু তারাও দাম হাঁকছেন অনেক বেশি। সিলেটভিত্তিক একটি প্রকাশনী থেকে এবার সাড়াজাগানো একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবি মঈন মুনতাসিরের ওই কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘শীষমহল’। এতে ৭৯টি খণ্ড-কবিতার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা রয়েছে। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৮। প্রতি ১৬ পৃষ্ঠায় এক ফর্মা হিসেবে বইটির আকার তিন ফর্মা। কাগজের মানও তেমন ভালো নয়। যদিও চার রঙা প্রচ্ছদটি দর্শনীয়। বইটিতে মূল্য লেখা রয়েছে ১৪০ টাকা। ২৫ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রিমূল্য হচ্ছে ১০৫ টাকা।
সিকি শতকের পুরোনো এক প্রকাশনীর প্রকাশিত একটি বইয়ের নাম ‘নারী ও ধর্ম’। পাঁচ ফর্মার বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮০। এর দাম লেখা রয়েছে ২২৫ টাকা। অর্থাৎ বইটিতে ফর্মাপ্রতি ৪৫ টাকা পড়ছে মূল্য। এ নিয়ে একজন ক্রেতা অভিযোগ করলে পরে বিক্রয়কর্মীরা ৩০ শতাংশ ছাড়ে বইটি বিক্রি করতে সম্মত হন। এ প্রসঙ্গে ওই স্টলের বিক্রেতারা বলেন, অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এ বইটিতে দাম একটু বেশিই মনে হচ্ছে। প্রকাশনীটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত তাদের প্রতিটি বইয়ের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফর্মাপ্রতি ৩০ টাকা ধরা হয়। এর সঙ্গে মলাট ও বাঁধাই বাবদ বাড়তি কিছু খরচ ধরা হয়। সে হিসাবে বইটির মূল্য ১৭০-৮০ টাকা হতে পারতো।
সব প্রকাশনীর বইয়ের বাহ্যিক মান অবশ্য একরকম নয়। কুঁড়েঘর প্রকাশনী থেকে গত বছর প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘পঞ্চনরক’। ছয় ফর্মার বইটির মূল্য লেখা রয়েছে ২০০ টাকা। অবশ্য বইটি ছাপা হয়েছে ১০০ জিএসএম (গ্রামপ্রতি বর্গমিটার) পুরুত্বের কাগজে, যা বেশ ভারী। পাশাপাশি বইটিতে রঙিন কাগজ ব্যবহার করায় খানিকটা দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। বইটির বাহ্যিক মানের জন্য অনেকেই বলছেন ২০০ টাকা মূল্য ঠিকই আছে। এর ওপর অবশ্য পাঠক ২৫ শতাংশ ছাড়ও পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির নির্দেশনা অনুসারে।
সাধারণত অধিকাংশ প্রকাশনী তাদের বই ৮০ জিএসএম পুরুত্বের কাগজে ছাপায়। তবে কোনো কোনো বইয়ে কাগজের মান আরও কম দেখা গেছে। কাগজের নি¤œমানের পরও দামের ক্ষেত্রে ফর্মাপ্রতি ৩০ টাকার নিচে তেমন একটা দেখা যায়নি।
এদিকে বাহ্যিক সাজসজ্জা ও কাগজের মানের পাশাপাশি তথ্য, জ্ঞান ও বিষয়ের গুরুত্বের কারণেও বইয়ের মূল্য বেশি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের প্রকাশক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ জাকির হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একটি বইয়ের পেছনে কী পরিমাণ শ্রম-মেধা ও অর্থ বিনিয়োগ করা হয়, তার ওপর নির্ভর করেই দাম নির্ধারিত হয়। পৃষ্ঠা ও আকার মেপে বইয়ের দাম নির্ধারণ করা যায় না। একটা বইয়ে লেখককে কত টাকা স্বত্ব দেওয়া হবে, বইটির ভাষা ও বানান নির্ভুল করতে গিয়ে সম্পাদককে কী পরিমাণ অর্থ দিতে হয়, তার পরিমাণের কারণেও মূল্য কম-বেশি হতে পারে। কোনো কিছু পেলেই তো আর প্রকাশ করা যায় না!’
সূচিপত্রের প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী সাঈদ বারী এতে
যোগ করেন, ‘বইয়ের লেখা ও সাজসজ্জার পাশাপাশি প্রচ্ছদগুলো আলাদা একেকটি শিল্পকর্ম। প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পীকেও দিতে হয় সম্মানী। সেগুলো হিসাব করেই আমরা বইয়ের দাম নির্ধারণ করি।’
প্রকাশকরা দাবি করেন, ‘অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বইয়ের মূল্য এখনও কম। তাছাড়া এদেশে অধিকাংশ বই ছাপানোর পর তা বিক্রির বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকে। এই অনিশ্চয়তার কারণেও বেশি মূল্য রাখা হয় বইয়ের গায়ে। এদিকে দেশের সর্বত্রই বই ক্রেতাকে বিভিন্ন পরিমাণে ছাড় দেওয়া হয়। গ্রন্থমেলায় সব প্রকাশনীকে ২৫ শতাংশ ছাড়ে বই বিক্রির নির্দেশনা রয়েছে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে। আর বাংলা একাডেমির নিজস্ব বইয়ের ওপর ছাড় দেওয়া হচ্ছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে ওই ছাড়ের সুবিধা ক্রেতারা পান না বলেও অনেকে জানিয়েছেন।’ এ প্রসঙ্গে অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের সৈয়দ জাকির হোসাইন বলেন, ‘দেশে কোথাও গায়ের দামে বই বিক্রি হয় না। যে ছাড়টা পাঠককে দেওয়া হয়, সে পরিমাণ মূল্য বইয়ের গায়ে সাধারণত বাড়তি লেখা হয়।’
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে এরই মধ্যে নাম করেছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক রবিউল করিম মৃদুল। এবার আসছে তার চতুর্থ গ্রন্থ ‘রকস্টার’। তিনি বলেন, বই হচ্ছে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি। বইয়ের মূল্য শুধু বাইরের চাকচিক্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে ঝকঝকে ছাপা, কাগজের মান, শক্ত বাঁধাই এবং নির্ভুল ভাষা নিশ্চিত করা গেলে পাঠক সন্তুষ্ট হন। সব দিক মিলিয়ে ভালো মানের বই-ই পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। সেটি করা না গেলে পাঠকরা মূল্য নিয়ে অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। মূল্য একটু বেশি হলেও যদি নির্ভুল ও মানসম্পন্ন বই ছাপা হয়, তবে তা শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।’
অবশ্য বইয়ের দাম বেশি হলেও বই কিনেই ফিরছেন ক্রেতারা। আবার গুণ ও মানের কারণে বেশি দামেও ক্রেতা সন্তুষ্ট অনেক বইয়ে।
জমে উঠেছে গ্রন্থমেলা দামে নাখোশ ক্রেতারা

Add Comment