এটিএম সেলিম সরোয়ার, জয়পুরহাট : ‘আলু আর ধান জয়পুরহাটের প্রাণ’এমন প্রবাদে পরিচিত উত্তরবঙ্গের ধানের জেলা জয়পুরহাট। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যের দাম হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দামও বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন আতঙ্কে তিন দিন ধরে জয়পুরহাটের আড়তগুলোয় চালের দাম বেড়েই চলছে। মোটা জাতের চাল প্রতি কেজিতে পাঁচ থেকে ছয় টাকা আর চিকন জাতের চালে ৯ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। গত তিন দিনে আড়তগুলোয় বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এতে বিপদে পড়েছেন জনসাধারণ।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দামও বাড়তে পারে বলে জনসাধারণের মধ্যে তিন দিন ধরে মজুত করার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম অস্বাভিকহারে বেড়েছে। চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মিল-চাতাল মালিকরাও উৎপাদন বাড়িয়েছেন। এ অবস্থায় বাজারে ধান কেনার প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এ কারণে ধানের দামও বেড়েছে।
জেলার বড় চালের বাজার কালাই উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির তালুকদার বলেন, গত বছর এ সময় ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে পাঁচশিরা বাজারসহ পুরো জেলার বিভিন্ন আড়তঘর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ গাড়ি চাল যেত। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের আড়তগুলোয় চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তিন দিন ধরে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ গাড়ি চাল পাঠানো হচ্ছে। আবার এলাকায় চালের দাম বাড়তে পারে বলে জনসাধারণের মধ্যে মজুত করার প্রবণতা বেড়েছে। সবকিছু মিলে চালের চাহিদা প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালের জোগান ঠিক রাখতে মিল মালিকদের মধ্যে ধান কেনার প্রতিযোগিতাও বেড়েছে।
গত বুধবার পাঁচশিরা বাজারে মোটা জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ৮৫০ থেকে ৮৭০ টাকায় আর চিকন জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়। অথচ শুক্রবার মোটা জাতের প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়, আর চিকন ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৪৫০ টাকায়। এতে মোটা জাতের প্রতিমণ ধানে ২০০ থেকে ২৩০ টাকা এবং চিকন জাতের প্রতি মণ ধানে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দাম বেড়েছে। এ কারণে পাইকারি বাজারে মোটা জাতের চালের দাম প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, আর চিকন জাতের চালে বেড়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে প্রচুর চাল মজুত আছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির ফলে চালের দামও বাড়তে পারে বলে জনসাধারণ যাবতীয় পূর্ণ ক্রয়ের পাশাপাশি চাল ক্রয় করতে হঠাৎ করে বাজারগুলোতে ঝুঁকে পড়েছেন। সে কারণেই চালের দাম বেড়েছে। এ চাহিদা অস্থায়ী। তবে চলতি মৌসুমে উৎপাদন বেশি হয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না ঘটলে চালের কোনো সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার সর্ববৃহৎ কালাই উপজেলার পাঁচশিরা পাইকারি বাজারে মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ চালের দাম ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। দুই দিন আগে এ চালের দাম ছিল দুই হাজার ১০০ থেকে দুই হাজার ১৫০ টাকা। শুক্রবার সেই চাল বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৪৫০ টাকায়। ফলে মোটা জাতের চাল কেজিতে বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। আর চিকন জাতের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১০ টাকা। দুই দিন আগে চিকন জিরাসাল চাল ৫০ কেজির প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টাকায়। শুক্রবার সেই চাল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ১৫০ থেকে তিন হাজার ২৫০ টাকায়।
কালাই পৌর শহরের কৃষকবন্ধু চালকলের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতি বছর নতুন ধান ওঠার পরপরই চালের দাম কমে। কিন্তু এবার বাজারে তার চিত্র উল্টো। নতুন ধান ওঠার সঙ্গে বাজারে বাড়তে শুরু করেছে ধানের সঙ্গে চালের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট মূল্যে চাল বিক্রির কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি (এলসি) করলে বাজার সহজেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।
কালাই উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি ও পাঁচশিরা বাজারের মেসার্স থ্রি এফ ফুড প্রসেসিং মিলের স্বত্বাধিকারী আব্দুল আজিজ বলেন, গত সপ্তাহে আমার মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে দু-তিন গাড়ি চাল বিক্রি হতো। কিন্তু তিন দিন ধরে ১০ থেকে ১২ গাড়ি করে চাল বিক্রি হচ্ছে। বাজারে অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়তে পারে, এমন শঙ্কায় এলাকায়ও জনসাধারণের মধ্যে চাল মজুতের প্রবণতা বেড়েছে। হঠাৎ করেই চালের চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়ে গেছে।
শুক্রবার জেলার পাঁচবিবি হাট, ক্ষেতলাল উপজেলার ইটাখোলা ও কালাই উপজেলার মোসলেমগঞ্জ হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাজারগুলোয় মোটা জাতের ধান বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দরে। তিন দিন আগে এসব মোটা জাতের ধানের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৮৭০ টাকা। আর চিকন জাতের ধান মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৪৫০ টাকায়। তবে দাম বাড়লেও কী হবে, বাজারগুলোয় ধানের জোগান ছিল কম আর চাহিদা ছিল বেশি।
জয়পুরহাট জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি লায়েক আলী বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দামও বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় লোকজন চাল মজুত করতে শুরু করেছেন। এ কারণেই ধানের সঙ্গে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনটা শুনেছি। তবে হঠাৎ করে কেন দাম বৃদ্ধি পেল, সেজন্য বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে। মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে। বাজার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আসবে। যদি অবৈধভাবে কেউ চাল মজুত করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।