আব্দুল হাকিম, রাজশাহী: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশের পশ্চিমাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা দেখছেন জলবায়ুবিদরা।
জলবায়ুবিদরা বলছেন, বাড়ছে নতুন নতুন রোগের প্রকোপ, বাড়ছে শঙ্কা। সম্প্রতি এল নিনো-লা নিনা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। বদলে যাওয়া জলবায়ুতে উত্তরাঞ্চলে প্রলম্বিত খরা, অসময়ে বৃষ্টি এবং তীব্র শৈত্য এখন নিয়মিত। নদী ভাঙনও নিয়মিত ব্যাপার। এর প্রভাব পড়ছে এখানকার অধিবাসীদের জীবন-জীবিকায়। প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
জলবায়ু পরিবর্তনে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে গবেষণায় করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) একদল চিকিৎসক। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী মেডিকো রিসার্চ ক্রনিকলস। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৬০ শিশুর ক্লিনিক্যাল উপস্থাপনা এবং পরীক্ষাগার প্রোফাইল বিশ্লেষণ করা হয় এ গবেষণায়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, ওই ৬০ জন শিশু শ্বাসযন্ত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ নিয়ে রামেক হাসপাতালে ভর্তি ছিল। যাদের বয়স ৫ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে। রোগীদের আয়রনের অভাবজনিত রক্ত স্বল্পতা ৩৩ শতাংশের ওপরে। ক্লিনিক্যাল মূল্যায়নে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীর চেহারা ফ্যাকাশে দেখা গেছে। হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসকষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীর। বুকে আঁকতে দেখা গেছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশকে। এ ছাড়া শ্বাস নেয়ার সময় শব্দ পাওয়া গেছে ১০ শতাংশের। বড় বড় শ্বাস নেয়ার সময় আঘাত এবং শব্দ পাওয়া গেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশের। অ্যাজমার উপসর্গ পাওয়া গেছে ৯০ শতাংশেরই।
গবেষক দলটির প্রধান রামেকের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্ত স্বল্পতা এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্র খুঁজতে তারা এই গবেষণাটি চালিয়েছেন। রক্ত স্বল্পতার একটি বড় কারণ পুষ্টিহীনতা। পুষ্টিহীনতায় হƒদরোগসহ শিশুদের নানা জটিল-কঠিন রোগ সৃষ্টি করছে। এজন্য বৃহৎ জনসংখ্যার ওপর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন বলে জানান এ গবেষক।
চিকিৎসকরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলে প্রচুর তাপমাত্রার ভেতর দিয়ে যেতে হয় শিশুদের। ফলে এখানকার শিশুরা তাপজনিত রোগ বিশেষ করে হিটস্ট্রোক এবং হƒদরোগসহ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রায় যেসব সংক্রমণ রোগ ঝড়ায় সেগুলোর ঝুঁকি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া তীব্র শৈত্যের কারণে ফুসফুসের নানা সংক্রমণেও ভুগছে শিশুরা। আর্থসামাজিক অবস্থায় নি¤œমানের হওয়ায় প্রকট হচ্ছে পুষ্টিহীনতা। এ থেকেই আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা বা এনিমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আবার এনিমিয়া আক্রান্ত অধিকাংশ শিশু শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের শিকার হচ্ছে।
এসব রোগ জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে তীব্র শ্বাসনতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে আসছে শিশুরা। ভাইরাসজনিত জ্বরও বেড়েছে আগের তুলনায়। ডায়রিয়াও বেড়েছে। উচ্চতাপমাত্রায় শিশুদের ‘হিট স্ট্রেস’ আক্রান্ত হতে পারে। এ থেকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতাও বড়দের তুলনায় শিশুদের কম। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। ফলে ডায়রিয়া ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পুষ্টিহীনতায় ভোগারও ঝুঁকি থাকে এসব শিশুদের।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রাধান অধ্যাপক ড. সীতাংশু কুমার পাল বলেন, এল নিনো ও লা নিনা প্রাকৃতিক বিষয়। এর সঙ্গে সমুদ্রস্রোত ও বায়ু প্রবাহ যুক্ত। এতে মানুষের কোনো হাত নেই। মানব সৃষ্ট কারণেও জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।