মেহেদী হাসান, রাজশাহী : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ষার দিনেও বৃষ্টি না হওয়ায় উত্তরাঞ্চলে হুমকির মুখে পড়েছে আউশ ও রোপা আমন ধানের চাষাবাদ। এ সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ জমিতে আমনের চারা রোপণ হওয়ার কথা। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে অধিকাংশ জমিতে চারা লাগানো যাচ্ছে না। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষাকালে যে পুঞ্জীভূত মেঘ বাংলাদেশে অবস্থান করার কথা সেটা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আছে। এজন্য বর্ষাকালেও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে না। গত এক দশক ধরেই আবহাওয়ায় এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ঋতু পরিক্রমায় এই পরিবর্তন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সামনে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যাবে। চাষিদের সম্পূরক সেচ দিয়ে চাষাবাদ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় এক হাজার ১০০ মিলিমিটার। ১০ বছর আগে রাজশাহীতে বছরে গড় বৃষ্টি হতো এক হাজার ৫০০ মিলিমিটার। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত বছর আষাঢ় মাসে রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছিল ২৫ দিন। আর এ বছর আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র আট দিন। গত বছর ৩৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এবার তা হয়েছে মাত্র ৩৯ দশমিক দুই মিলিমিটার। বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৮৯ শতাংশ। তবে এবার যে বৃষ্টি হয়েছে সেটাও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সময়ের জন্য। তাপমাত্রা ছিল গড়ে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, জুলাই মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় ৪৫৩ মিলিমিটার। কিন্তু গেল ২০ দিনে রংপুর বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ২০২০ সালে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০৪ মিলিমিটার। ২০২১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬ মিলিমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যে তাপদাহের বিপর্যয়, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সংকট। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। ফলদ ও ফুলের পাশাপাশি পশু-পাখির উপযোগী বৃক্ষরোপণ অপরিহার্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২০২২-২৩ খরিপ-২ মৌসুমে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত উত্তরের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোনে লক্ষ্যমাত্রার শতকরা প্রায় ৯ ভাগ জমিতে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সেটিও করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর-বিবিএস আউশ ফসলের প্রাক্কলিত হিসাব শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর দেশে আউশের আবাদ হয়েছে ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে
বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রাম গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি নেই। কৃষকেরা এটা ভাবতেই পারছে না। এ রকম বৈরী আবহাওয়া আগে কখনই দেখেননি। একই কথা বলেন আরও ২০-২৫ জন কৃষক। সাপাহার উপজেলার গোয়ালভিটা গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে গভীর নলকূপের পানি দিয়ে আমনের জমি রোপণ করতে গিয়ে শ্রমিক খরচ, হালচাষ ও সার-কীটনাশক দিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৪ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে বোরোর আবাদ করতে যে ৯-১০ হাজার টাকার মতো খরচ হতো আমনেও তেমন খরচ হবে।
পাবনার ঈশ্বরদীর সাঁড়া গোপালপুরের কৃষক মোতাহার বলেন, তিনি ৯ বিঘা জমিতে এবার আমন ধান চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বৃষ্টি না হওয়ায় এখনও চারা রোপণে জমি প্রস্তুত করতে পারেননি। পরিমাণ মতো বৃষ্টি না হলে অনেক কৃষক আমন ধান লাগাতে পারবে না। এদিকে বৃষ্টির অভাবে কৃষকরা আউশ ক্ষেতে সেচ দেয়া নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। এবার উত্তরের চাষিরা ধান উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল হাসান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে আমন চাষে তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা। প্রথমত সেচে বাড়তি খরচ, দ্বিতীয়ত খেতে আগাছা, রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং তৃতীয়ত উৎপাদিত ধানে ভালো মানের চাল পাওয়া যাবে না।
রাজশাহী আবহওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান জানান, রাজশাহীতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত অনেক কমেছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে। কেননা রাজশাহীতে যে পরিমাণ গাছ লাগানো হচ্ছে তার চেয়ে কাটা হচ্ছে বেশি। আবার নদীর নাব্যতাও কমেছে। সব মিলিয়ে জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া আবহওয়ার খামখেয়ালিপনা বাড়ছে।
তবে রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ জানান, এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সামনের সপ্তাহে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আমন রোপণে লক্ষ্যমাত্রা অজির্ত হবে বলে আশা করছেন তিনি। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ জানান, তারা সেচকার্য পরিচালনা করছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আবদুল্যাহ আল মারুফ গণমাধ্যমকে বলেন, রাজশাহী যে তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী। আমরা গবেষণা করে যেটা পেয়েছি তা হলো, প্রতি বছর দশমিক ০০৩ করে তাপমাত্রা বাড়ছে। তিনি মনে করেন, রাজশাহী অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ার কারণ জলাশয় ও পুকুর ভরাট, বৃক্ষ নিধন, বহুতল ভবন নির্মাণ। এজন্য রাজশাহীর তাপমাত্রা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তিনি আরও বলেন, তাপপ্রবাহ মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। আমাদের সবাইকে গাছ লাগিয়ে আবার গ্রিন বলয়ে ফিরে আসতে হবে। নাহলে এই অঞ্চলে প্রতি বছর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।