Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:25 pm

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতারা কী ভাবছেন?

মো. মিজানুর রহমান: সংযুক্ত আবর আমিরাতের দুবাইতে গত ৩০ নভেম্বর শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৮) যা শেষ হয়েছে ১২ ডিসেম্বরে। এবারে কপ ২৮ সম্মেলনকে সর্বকালের বৃহৎ আকারে জাতিসংঘের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ এবারের সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধি মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার অংশগ্রহণকারী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কার্বন নিঃসরণ। বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজস্ব ক্ষমতায় কতটুকু হ্রাস করতে পারে সেটা সবার পরিকল্পনা ও ভাবনা নিয়ে এ আয়োজন, সম্মেলন ঘিরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও ছিল সবার।

দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন তাপমাত্রা বৃদ্ধি না পায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এ মহাপরিকল্পনা থেকে এ আয়োজন প্রতি বছরের মতো হয়ে গেল। এটা বাস্তবায়নের পেছনে শিল্পোন্নত দেশগুলো বরাবর সবচেয়ে বড় বাধা। জলবায়ু কিন্তু পরিবর্তন হয় সাধারণত গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে। যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এর পেছনের কারণগুলো কী কী সবার সচেতনতার জন্য জানা দরকার। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম কারণগুলো হলো:

ক. অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে; খ. যানবাহনের অদদ্ধীভূত কার্বন; গ. তেজস্ক্রিয় দূষণ যেমন ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে পারমাণবিক দ–র্ঘটনা; ঘ. শিল্পকারখানার বিষাক্ত নির্গত ধোঁয়া ও বিষাক্ত বর্জ্য এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় শিল্পায়ন; ঙ. অপরিকল্পিতভাবে বনভূমি উজাড় ও বনভূমিতে দাবানল; চ. মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রীÑএসি ও প্রসাধন সামগ্রী ও প্লাস্টিক সামগ্রী; ছ. জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধি ও অসম বণ্টন; জ. ওজোনস্তর ক্ষয় হয়ে সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছানো; ঝ. কৃষিক্ষেত্রে সার ও ওষ–ধ প্রয়োগে পানি দূষিত হয়ে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া; ঞ. আগ্নেয়গিরি উৎপাতজনিতসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণগুলো।

উপরিউক্ত কারণ ছাড়া আরও নানাবিধ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়। জার্মান ওয়াসের তথ্য মতে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা, উপকূলীয় মাটি ও ভূগর্ভস্থ অতিরিক্ত লবণাক্ততা, সেই সঙ্গে সুপীয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি, নদীভাঙনের ফলে বাস্তুহারা বৃদ্ধি মানুষের কাজের অভাব তীব্রতর হয়। এগুলোর নমুনা দেখে বাংলাদেশ অভ্যস্থ।

এরই মধ্যে কাতারে কপ-২৮ সম্মেলন হয়ে গেল। অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমস্যা একই রকম। এ অঞ্চলের দেশগুলোর একটাই চাহিদা থাকে এবং সেটার জন্য তাকিয়ে থাকে সেটা হলোÑপ্রচুর পরিমাণে জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি বরাদ্দ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আর্থিক সহায়তা দাবি বহু দিনের অথচ দুই দশক ধরে উন্নত দেশগুলো তেমন জোরালো ভূমিকা দৃশ্যমান হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০০৯ সালে করা জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্লেষকরা। তবে এবারের সম্মেলনে আশার কথা হলো সম্মেলনের শেষ দিনে ও জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে আরও ১০ কোটি ডলার জমার অঙ্গীকার এসেছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত তহবিলে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো ৮০ কোটি ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করল। এর আগে গঠিত সবুজ জলবায়ু তহবিলে (জিসিএফ) ৩১টি দেশ ১ হাজার ২৮০ কোটি ডলার অর্থ দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস শুরু করার বিষয়ে সম্মত হয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি করেছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। জলবায়ুর পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব এড়াতে এটিই এ ধরনের প্রথম চুক্তি। যদিও সৌদি আরবসহ ওপেক অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর চুক্তির বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা সত্ত্বেও এ চুক্তির মাধ্যমে কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের চূড়ান্ত সমাপ্তির সংকেত দিচ্ছে। প্রায় ২০০টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বিনিয়োগকারী এ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের মাঝে ভাবনায় ফেলে দেবে। তাছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ঘোষণা এসেছে। বলা হয়েছে রাষ্ট্রগুলোকে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কয়লা খাতে ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। তেল ও গ্যাস নির্ভরশীল বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎ, হাইড্রোজেনসহ কম কার্বন নিঃসরণকারী উৎসে জোর দিতে হবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর নতুবা এ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাবে।

জেএসটিতে বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে ধরে রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বণ নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। কারণ প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করলেও এ শতাব্দীতে তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি বাড়তে পারে।

সম্মেলন শেষে তার বক্তব্যে কপ-২৮ এর প্রেসিডেন্ট সুলতাল আল জাবের এ চুক্তিকে ঐতিহাসিক বলে অবিহিত করেছন। তিনি বলেন, প্রকৃত সফলতা আসবে তা বাস্তবায়নে। তিনি শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেছেন, কথা নয় কাজেই আমাদের পরিচয়। বিশ্ববাসী সবার কর্মপরিধি এবং তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে আগামী বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকবে কি না।

ব্যাংকার