জলযান নির্মাণে শুল্কবৈষম্য আমদানিতে বড় ছাড়

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: বিভিন্ন ধরনের জলযান আমদানিতে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশে এ জাহাজ নির্মাণে শুল্কবৈষম্য রয়েছে। এজন্য জলযান আমদানিতে শুল্কহার দ্বিগুণ করার দাবি জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
জাহাজনির্মাতাদের মতে, বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা এখন বিভিন্ন ধরনের জলযান নির্মাণে সক্ষম। আর এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কছাড়, পাঁচ শতাংশ সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থা করা এবং আমদানি করা জাহাজে শুল্কহার বাড়ানো প্রয়োজন।
জানা গেছে, দেশে ফিশিং ট্রলার আমদানিতে মাত্র এক শতাংশ কাস্টমস কর দিতে হয়, অথচ দেশীয় নির্মাতাদের একটি ফিশিং ট্রলার নির্মাণে গড়ে ৪০ শতাংশ কর-ভ্যাট, ১৪ শতাংশ ঋণের সুদ, ৩০-৩৫ শতাংশ স্থাপনা ও পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয় হয়। বিপুল পরিমাণে খরচের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এতে একদিকে দেশীয় শিল্প বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, যা দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় জাহাজনির্মাতাদের জন্য তেমন সুখবর না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেন জাহাজনির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, জলযান আমাদনির ওপর শুল্কহার দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন বিভিন্ন ধরনের জলযান নির্মাণে সক্ষম। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়বে।
জাহাজনির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন এইওএসআইবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে (২০০৮-২০১৮) বিশ্বের ১৫টি দেশে মোট ৪২টি জাহাজ রফতানি হয়েছে, যা থেকে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আয় হয়েছে, প্রায় এক লাখ দক্ষ শ্রমিক তৈরি হয়েছে এবং এ শিল্পের সহযোগী ১৭টি ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠেছে। এ শিল্প এখন একটি উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন বৃহৎ শিল্প হিসেবে প্রকাশ পাওয়ায় বাংলাদেশের সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।
কাস্টমস করহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে পাঁচ হাজার টনের কম বাংলাদেশি নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে এক শতাংশও কাস্টমস কর দিতে হয় না। ফিশিং ট্রলার কিংবা ড্রেজার আমদানিতে মাত্র এক শতাংশ কাস্টমস কর দিতে হয়। আর ওয়ারশিপ আমদানিতে দিতে হয় পাঁচ শতাংশ এবং যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ (উভয় কাজে ব্যবহƒত), টাগ বোট, রেফ্রিজারেট জাহাজ, লাইটার জাহাজ, ভাসমান ক্রেন, ট্যাংকার, ফেরি বোট, ক্রুজ শিপ ইত্যাদি আমদানিতে মাত্র ১০ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক দিতে হয়। অথচ দেশীয় নির্মাতাদের জলযান নির্মাণে বিদেশিদের চেয়েও কম খরচে নির্মাণের সক্ষমতা আছে।
জাহাজনির্মাতারা বলেন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশেও জাহাজ রফতানি করছে। তবে পুঁজিঘন-শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় বিপুল পরিমাণে খরচের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এছাড়া নামমাত্র কাস্টমস শুল্ক দিয়ে একশ্রেণির ফটকাবাজ ব্যবসায়ী-দালালরা পুরোনো কিংবা ত্রুটিপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের জলযান সহজে আমদানি করছে। এতে একদিকে দেশীয় বাজার সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশগত ঝুঁকি, অর্থ পাচারের মাধ্যম ও দুর্নীতির সুযোগ বাড়ছে। এজন্য আমদানি করা বিভিন্ন জলযানের ওপর বিদ্যমান শুল্কহার দ্বিগুণ করার দাবি করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে কাঁচামাল যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কছাড় এবং পাঁচ শতাংশ সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থার দাবিও জানান তারা।
তারা বলেন, চীনে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র চার শতাংশ সুদে ব্যাংকঋণ পায়। এছাড়া জাহাজ নির্মাণের অন্যতম কাঁচামাল ইস্পাতের তৈরি পাত নিজ দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ শতাংশ ভর্তুকি পায়। জাহাজ রফতানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেয় দেশটির সরকার। অথচ বাংলাদেশে সুদের হার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। রফতানিমূল্যে প্রণোদনা ১০ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া গেলেও চীনের মতো ভর্তুকি নেই। ফলে শ্রমিকের মজুরি কম হলেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো।
এইওএসআইবির সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণের অধিকাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর বিদ্যমান করকাঠামোর কারণে কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশভেদে সর্বনি¤œ পাঁচ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। এছাড়া কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের সুদ, পরিচালনা খরচ মিলে জাহাজ নির্মাণে মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ হয়। অথচ বিভিন্ন ধরনের জলযান আমদানিতে খুব অল্প কর ও ভ্যাট দিতে হয়। অথচ একটি জাহাজ নির্মাণে তিনবার কর ও ভ্যাট দিতে হয়। ফলে আমাদের কাক্সিক্ষত মুনাফা হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে টিকতে বেগ পেতে হচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এ বিকাশমান দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় সরকারকে অবশ্যই আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে, কিংবা বিদ্যমান শুল্ককাঠামো দ্বিগুণ করতে হবে। আমরা এখন বিশ্বে ‘শিপবিল্ডিং ন্যাশন’ হিসেবে পরিচিত।’
উল্লেখ্য, দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৭৩টি জলযান আমদানি করা হয়। এ সময়ে টাগ বোট ও পুশার ক্রাফট আমদানি হয়েছে ২৫টি, লাইটার জাহাজ ১৭টি, তিন হাজার টনের অয়েল ট্যাংকার চারটি, ফিশিং ট্রলার ছয়টি, পাঁচ হাজার টনের অয়েল ট্যাংকার ছয়টি ও অন্যান্য ১৫টি। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরও ২৫টির বেশি জলযান আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ১৫টির বেশি টাগ বোট আমদানি করা হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০