‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম
মহেশখালীর পানের খিলি তারে
বানাই খাবাইতাম।’
মহেশখালীতে বেড়াতে যান বা না যান, এখানকার পানের খিলি চেখে দেখুন আর নাইবা দেখুন, শেফালী ঘোষের এ বিখ্যাত গানটি কমবেশি শুনেছেন নিশ্চয়। কমবেশি সবাই এ গানটির সঙ্গে পরিচিত। তার এ গানের মাধ্যমেই নাকি মহেশখালীর নাম দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তখনকার দিনে মহেশখালীর তেমন পরিচিতি ছিল না। এর প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্যের কথা দেশের অনেকেই জানতেন না। সেদিন আর নেই, দৃশ্যপট পাল্টে গেছেÑএখন মহেশখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। বর্তমানে কেউ কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে মহেশখালী থেকে ঘুরে আসার জন্য এক দিন হাতে রেখেই যাওয়ার চেষ্টা করেন।
আমি তো দু-এক বছরের মধ্যে অন্তত একবার হলেও কক্সবাজারে যাই। তবে সাত বছর ধরে মহেশখালীতে যাওয়া হয়নি। এবার কক্সবাজারে গিয়ে সমুদ্রসৈকতে একটি ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠে শেফালী ঘোষের এ বিখ্যাত গানটি শুনে সিদ্ধান্ত নিই মহেশখালীতে বেড়াতে যাব। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরদিন সকালে আমরা কয়েক বšু¬ মিলে কক্সবাজার থেকে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা দিলাম।
কক্সবাজারের বিআইডব্লিউটিএ’র ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে দেখি, বঙ্গোপসাগর চ্যানেলটি বেশ উত্তাল হয়ে রয়েছে। এ অবস্থা দেখে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। দুজন বললেন, যাওয়ার দরকার নেই; কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। একজন প্রস্তাব রাখেন, সড়কপথে চকরিয়া থেকে বদরখালী হয়ে মহেশখালীতে যাওয়ার। তবে এতে অনেক সময় লাগবে। তাই বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে স্পিডবোটে চড়ে রওনা দিলাম। স্পিডবোটে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে আমাদের সবার চোখে পানি এসে গেল। অবস্থা ছিল এমন ঢেউয়ের তোড়ে স্পিডবোট যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। প্রাণভয়ে আমাদের একজন হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। যাহোক, বিশাল এক দুঃসাহসিক অভিযান সেরে আমরা পৌঁছে গেলাম মহেশখালীর জেটির ঘাটে।

জেটি ঘাটটি ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মাণ করে। ঝাউবনের মধ্য দিয়ে ১৮২টি পিলারের ওপর জেটি দণ্ডায়মান। জেটি নির্মাণের আগে মহেশখালীর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল বেশ নাজুক। স্পিডবোট থেকে নেমে ঝাউবনের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সরু জেটি ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দু’পাশে ঝাউবন, সুনসান নীরবতা আর সাঁইসাঁই বাতাস সময়টাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। এরই মধ্যে আমাদের ভয় কেটে গিয়েছি। আলাদা প্রশান্তি অনুভব করছি। জেটির শেষ প্রান্তে এসে রিকশা ও টমটম পেয়ে যাই। সারা দিনের জন্য আমরা একটা টমটম ভাড়া করে নিলাম।
টমটমযোগে প্রথমে গেলাম রাখাইন পাড়ায়। এখানে অনেকটা সময় নিয়ে ঘুরে দেখলাম তাদের জনজীবন, হস্ত ও বস্ত্রশিল্পের কারুকাজ। কারও সঙ্গে গল্প করেছি। তাদের ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হয়েছি আমরা। তাদের বাংলায় কথা বলার ধরনটা শুনে বেশ মজা পাই। তবে শুধু গল্পই করিনি, পছন্দমতো আমরা কিছু হস্ত ও বস্ত্রশিল্প কিনেছিলাম সেদিন। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে।
মুগ্ধ হয়ে স্বর্ণমন্দিরে অসাধারণ স্থাপত্য দেখি। দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্যখচিত স্বর্ণমন্দির দেখতে দেখতে একসময় প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করি। কাছের একটি খাবার হোটেলে গিয়ে সামুদ্রিক কোরাল মাছ ও বিভিন্ন ধরনের শুঁটকিভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এরপর সোজা চলে গেলাম মৈনাক পাহাড়ে। এখানে রয়েছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো আদিনাথ মন্দির। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে আদিনাথ মন্দিরের চারপাশ দেখলাম। প্রতিবছর ৪ মার্চ চতুর্দশী মেলা বসে এখানে, লাখ লাখ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। তখন এ স্থানটি হয়ে ওঠে বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।

ইচ্ছা ছিল সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে দেখার, কিন্তু সবারই ছিল ফিরে যাওয়ার তাগিদ। তাই পরবর্তী সময়ে সোনাদিয়া দ্বীপ দেখার ইচ্ছা মনে পুষে রেখে আবারও ফিরে গেলাম কক্সবাজারে। আর হ্যাঁ, ফেরার পথে মহেশখালীর কিছু পানের খিলি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম কাছের মানুষদের জন্য।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা উড়োজাহাজে চড়ে কক্সবাজারে যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে চাইলে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নেমে কক্সবাজারের বাস ধরতে হবে। কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী বিচ থেকে রিকশা কিংবা টমটমযোগে বিআইডব্লিউটিএ’র ৬ নম্বর ঘাটে যেতে হবে। এখানে থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে চেপে মহেশখালীতে যেতে পারবেন। স্পিডবোটে মাথাপিছু ৭৫ টাকা ও ট্রলারে ৩০ টাকা খরচ পড়বে।
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান