নাজমুল হুসাইন ও সাইফুল আলম: কয়েক দিন আগে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল দেশের প্রধান পণ্যবাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এখন নেমে গেছে পানি; ফলে স্থবিরতা কাটিয়ে আগের মতো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জ-চাক্তাই এলাকার ব্যবসা। কিন্তু সেই জলাবদ্ধতার প্রভাব পড়েছে এখন ভোক্তাদের ওপর। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার অজুহাতে গত দু’দিনে লাগামহীনভাবে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা গত কয়েক দিন ধরেই দাবি করে আসছেন, টানা তিন দিনের জলাবদ্ধতায় এবারের ক্ষতির মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কম-বেশি ৮৫ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে প্লাবিত ছিল। জলাবদ্ধতায় এবার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জে দেড় হাজারের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফলে বেড়ে যাবে পণ্যমূল্য।
ব্যবসায়ীদের ওই বক্তব্যের জেরেই দু’দিনের মাথায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, কাঁচামরিচ, মসলাসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।তবে বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এ পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বাড়ানোর অভিপ্রায় থেকেই ক্ষতির অতিরঞ্জিত তথ্য দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, অনেক ব্যবসায়ী সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা পাওয়ার আশায় ক্ষতির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাবি করছেন। সেটি কার্যকর না হলেও পরে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য এটি একটি অজুহাত। এছাড়া ব্যাংকসহ বাজারের বিভিন্ন সমিতির পাওনা পরিশোধ না করা এবং ইন্স্যরেন্স সুবিধা নেওয়ার জন্যও ক্ষতি বেশি দেখানো হয়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ-প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পণ্যের দাম নির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ। তারা কোনো অজুহাত পেলেই প্রথমে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। এরপর সবাই মিলে অসাধু পন্থায় দাম বাড়ান।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তাদের লোকসানের সব বোঝা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সবাইকে জিম্মি করে ফেলেন সংঘবদ্ধভাবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজার তদারকি সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।’
গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রামের চাক্তাই, নতুন চাক্তাই, চরচাক্তাই, পুরাতন চাক্তাই, মকবুল সওদাগর রোড, আসাদনগর, খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মার্কেট, চান্দমিয়া গলি, ইলিয়াছ মার্কেট, বাদশা মার্কেট, সোনামিয়া মার্কেট, নবী মার্কেট, মোল্লা মার্কেট, চাক্তাই মসজিদ গলি, ড্রামপট্টি, চালপট্টি, এজাজ মার্কেটসহ সব দোকান ও আড়ত এখন বিভিন্ন ধরনের পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও সরবরাহে ব্যস্ত সময় পার করছে। কয়েক দিন ব্যাহত হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি আনাগোনা মালবাহী যানগুলোর।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতার উপস্থিতে বেশি হওয়ায় লেনদেনও চাঙা। পণ্যের কোনো সংকট নেই। তবে বাজারে পণ্য বেচাকেনা হচ্ছে বেশি দামে।
বহদ্দারহাট এলাকা থেকে আসা খুচরা বিক্রেতা জাফর উল্লাহ বলেন, ‘পাইকারি পেঁয়াজ, রসুনের দোকানগুলো পণ্যের দাম বেশি নিচ্ছে। গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ১৮ টাকায় কিনেছি, তার দাম এখন দ্বিগুণ। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৮ টাকা। বৃষ্টির কারণে কত ক্ষতি হয়েছে যে, কেজিতে ১০ টাকা দাম বাড়ে?’ সবই পাইকারদের কারসাজি বলে অভিযোগ এ খুচরা বিক্রেতার।
এদিকে রাজধানীর প্রধান মসলাপণ্যের শ্যামবাজার ঘুরে দেখা গেছে, এ বাজারেও দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। দুদিনের ব্যবধানে পাইকারিতে প্রতি কেজি আদা-রসুনের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। একইভাবে কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে সাত টাকা। এছাড়া কাঁচামরিচের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেড়ে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সবজি ও প্রায় সব ধরনের মসলা, আটা ও ডাল বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে।
দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষোভ নিয়ে খাতুনগঞ্জ এলাকার আমদানিকারক ও পাইকারি আড়তদার মোহাম্মদী বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী রবিউল হোসেন বলেন, ‘গত সপ্তাহে যে লাখ লাখ টাকা লোকসান দিলাম, তা পূরণ করতে হবে না! দাম বাড়িয়েই তো ক্ষতি পূরণ করতে হবে। আমরা তো বাড়ি থেকে এনে লোকসান দেব না। সবাই তো দাম বাড়াচ্ছে।’
তবে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সৈয়দ সগীর আহমেদ বলেন, ‘টানা বর্ষণ আর জোয়ারের পানি কাঁদিয়েছে ব্যবসায়ীদের। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যে। এর দায় কোনোভাবেই দর বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোক্তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষাকালে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ সমস্যা আঞ্চলিক নয়, জাতীয় সমস্যা হিসেবে নিয়ে সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। নতুবা ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়কে ক্ষতিতে পড়তে হবে।’
প্রসঙ্গত, দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিত বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি উঠছে। এটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর জলাবদ্ধতা হলেই হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো সংগঠন বা সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতির সেভাবে পরিসংখ্যান করা হয় না। কিন্তু এমন পরিস্থিতির পর প্রতিবছর বাড়ে পণ্যের দাম।