Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:06 am

জলাভূমি নির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবনও জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : জীবন ও জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ জলাভূমি। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ইত্যাদি পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে, যা আমাদের সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের আধার। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে বর্তমান বাস্তবতায় জলাধারগুলো রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চারপাশের বাতাসকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমি গুরুত্ব অনেক বেশি। এছাড়া শহরাঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য ও নাগরিক জীবনকে বাসযোগ্য করার জন্য জলাভূমির ভূমিকা রয়েছে। অথচ শিল্পবিপ্লবের পর থেকে প্রতিটি দেশে দখল আর দূষণে জলাভূমিগুলো হারাতে বসেছে। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতির ওপর; যা পৃথিবীজুড়ে দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেয়া (২০ জানুয়ারি ২০২৪) তথ্যানুযায়ীÑগত ১০০ বছরে আমাদের পানির চাহিদা প্রায় ছয় গুণ বাড়ছে, কিন্তু আশ্চার্যের বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীর ৩৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। তাই পৃথিবীর প্রায় ৮২ শতাংশ মানুষ দূষিত পানি ব্যবহার করছে। এই তথ্যগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের জলাভূমি সংকটাপন্ন। জলাভূমি নিঃশেষ হয়ে পড়ায়, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ছোট নদীর অনেকগুলোই অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে। কোনটি পরিণত খাল-ডোবা-নালায়, যা এখন চেনাই যায় না। অনেক ছোট নদী ও বিল অস্তিত্ব হারিয়ে মানুষের মুখে মুখে শুধু নাম নিয়েই বেঁচে আছে। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে জলাভূমিনির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। 

 ‘জলাভূমির দেশ’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৪ লাখ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারপরও জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে পারছে না। দেশের অন্যতম বৃহৎ জলাধার চলনবিলের আয়তন আগের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়েছে। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানের জলাধারগুলো বিভিন্ন সময় লিজ বা ইজারা দেয়ার ফলে লাভের চেয়ে জলাধারগুলোর বৈশিষ্ট্য বেশি নষ্ট হয়েছে! ফলে উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দেশি মাছের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যা এখনও চলমান রয়েছে। ২০২৪ সালের প্রচণ্ড খরতাপে অনেক পুকুর শুকিয়ে গেছে। পানি উত্তপ্ত হওয়ার ফলে মাছ চাষ ব্যবহƒত হচ্ছে। এখানে-ই শেষ নয়, মহানন্দার মতো নদী শুকিয়ে গেছে। পায়ে হেঁটেই এখন মানুষ এ নদী পার হচ্ছে। এছাড়া পানিশূন্য হয়ে পড়ছে নওগাঁর আত্রাই নদী। ফলে বোর চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক, যা অর্থনীতির ওপরও চরম প্রভাব পড়ছে। একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে-বুঝে নিজের ক্ষতি ডেকে আনা।  

অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নদী, খাল, ঝিল, আর জলাশয় ভরা একসময়ের সবুজ নগরী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক শহর তার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হারিয়ে গেছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান ২০২২ অনুযায়ী, রাজউকের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩ হাজার ৪৬৪টি পুকুর আছে। এর মধ্যে ২০৫টি ঢাকার মধ্যাঞ্চলে। রাজধানীতে এক সময় প্রায় ২ হাজার পুকুর, ৫২টি খাল ও অসংখ্য ঝিল ছিল। কিন্তু এর বেশিরভাগ-ই এখন আবাসনের চাহিদা মেটাতে নিচু জায়গা ভরাট করতে করতে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। অবিশ্বাস্য মনে হয়, গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপির) একটি গবেষণা তথ্য মতে, ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ জলাধার রয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার এবং অন্যান্য সংস্থার কারণে ঢাকা ৯৫৫৬ একর বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, জলধারণ এলাকা এবং জলাশয়ের মধ্যে ৩৪৪০ একর-ই হারিয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের অপর এক জরিপ তথ্য বলছে, ঢাকার দুই সিটিতে মোট পুকুরের সংখ্যা ৭১টি। এর মধ্যে সরকারি ৪৮টি, ব্যক্তি মালিকানার ২৩টি এবং ঢাকায় ১৪টি লেক আছে। এছাড়া ২০১৯ সালে ঢাকা ও এর চারপাশের জলাশয় ভরাটের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে গেছে। গত সাড়ে তিন দশকে ঢাকা হারিয়েছে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল।

২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৩০ বছরে ঢাকার ৬০ শতাংশের বেশি জলাভূমি হারিয়ে গেছে। ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে একটি জরিপে অবিভক্ত ঢাকা শহরের মানচিত্রে ৬৫টি পুকুর চিহ্নিত করা হয়েছিল। যাদের অনেকগুলোকেই ভরাট করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য যে আইন আছে; সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও একই আইন হলেও গত ৩৫ বছরে ঢাকায় জলাশয় (পুকুর, খাল ও নালা) কমছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যার পরিমাণ ১০ হাজার হেক্টরের বেশি। এ সময়ে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ এবং নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ বিপৎসীমার নিচে নেমে আসবে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, জলাধারগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন হোক বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে হোক; আইনানুযায়ী এর শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এগুলোকে জলাধার হিসেবে-ই রাখতে হবে। রাজধানীর পুকুরগুলো সংরক্ষণ করার কথা ড্যাপের প্রস্তাবেও আছে। অথচ সরকারিভাবেও জলাশয় ভরাটের মহোৎসব চলছে। মহানগর এলাকায় জনসংখ্যা বিবেচনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ বিভিন্ন আইন ও উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও জলাশয় কমতে কমতে ঢাকায় ৫ ভাগে নেমে এসেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পুকুর ও জলাশয় ভরাট করছে। ঢাকার অধিকাংশ জলাশয় ও পুকুর দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। জলাধার ভরাট করে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান-ই গড়ে উঠছে। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) আশকোনার হজ

 ক্যাম্পের কাছে একটি জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্পে করছে। সম্প্রতি গাবতলীতে বিএডিসি আর কুড়িলে রেলওয়ে জলাধার ভরাটের যে নজির দেখিয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে-ই প্রশ্ন উঠে জলাধারের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এমনকি তার আগেও ঢাকার পান্থপথে পানি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে পুকুর ভরাট করে। পুরান ঢাকার অনেক পুকুর দখলের মাধ্যমে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। কল্যাণপুরের ১০০ একর জলাশয় তিন একরে নেমে এসেছে। ওইসব কার্যক্রম দেশের জলাশয়গুলো ভরাট হবে না এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যদিও মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উš§ুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য ২০০০ সালে প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইনটি করা হয়েছে। আইনে প্রাকৃতিক জলাধার বলতে নদী, খাল, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসেবে মাস্টার প্ল্যানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোনো সংস্থার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ঘোষিত কোনো জায়গা এবং পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিকেও বোঝানো হয়েছে। ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতিতে। বেশিরভাগ খাল ও নিচু জায়গা ভরাট করে ফেলার ফলে এখন একটু বৃষ্টি হলেই নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় পড়তে হয়। চারপাশের নদীগুলোর সঙ্গে খালগুলোর সংযোগ কাটা পড়ছে। চট্টগ্রাম শহরও জলাধার হারিয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। চট্টগ্রামে ৩৪ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৮ হাজার জলাধার। প্রতিদিন-ই জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯১ সালের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। ২০০৬-০৭ সালে চালান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আরেকটি জরিপে দেখা যায়Ñনগরীতে জলাশয়ের পরিমাণ মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে এর কোনো সঠিক চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগের কাছেই নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাধার সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা-ই এই অবস্থার জন্য দায়ী। প্রয়োজনীয় জলাধার না থাকায় এই বছর (২০২৪ সালে) তীব্র তাপদাহে প্রাণ-প্রকৃতি হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শতাংশ জলাভূমি থাকার কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।

জলাশয়ের পরিবেশগত এবং আর্থ-সামাজিক মূল্য রয়েছে। জীববৈচিত্র্যের বিকাশে সহায়তা, বৃষ্টির পানির জলাধার এবং পানি নিষ্কাশনে জলাশয়গুলো অবদান রাখে। জলাশয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই বুঝতে হবে। তারপরও জলাশয়ের প্রয়োজন আছে কিনা, অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে! মহাসমুদ্রে ঝড় উঠলে যেমন বোঝা যায়, স্রষ্টা আছে কিনা? তেমনি বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরে এবং ২০২৪ সালের প্রচন্ড তাপদাহের সময় বোঝা গেছে জলাশয়ের প্রয়োজনীয়তা। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহর অঞ্চলে আগুন লাগার ঘটনা পরে তখন অগ্নিনির্বাপণে এবং একটু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, তা  নিষ্কাশনে সেখানে জলাশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা কংক্রিটে মোড়ানো থাকায় বৃষ্টিরর পানি নিষ্কাশনের উপায় থাকে না এবং ভারী বৃষ্টিপাতের সময় তীব্র জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জলাশয়গুলো ভরাট করার কারণে এই শহর কোনো ভারী বন্যা সামাল দিতে পারে না। যে জলাশয়গুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোরও করুণ অবস্থা। এগুলো রক্ষায় সরকার অনতিবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি এসব জলাশয় সুরক্ষার জন্য মনিটরিং বাড়ানো ও প্রাসঙ্গিক আইন প্রয়োগ করা জরুরি।  

আইনজীবী