Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 3:00 am

জলে যেতে বসেছে পশুর নদ ড্রেজিংয়ের ১২৩ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের জন্য মোংলা বন্দর থেকে ১৩ কিলোমিটার উজানে পশুর নদের চ্যানেলটি ড্রেজিংয়ে একটি প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৬ সালের জুলাইয়ে। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হলেও এখনও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। উল্টো পশুর নদে পলি পড়ার হার অনেক বেশি বলে প্রকল্পের উদ্দেশ্যে পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। বরং নতুন করে পলি জমতে শুরু করেছে ড্রেজিং করা অংশে।

শুধু তা-ই নয়, কতটুকু ড্রেজিং করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। এছাড়া পশুর নদে স্রোত বেড়ে যাওয়ায় নদীভাঙনের শঙ্কা বাড়ছে। রামপালে নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতে পশুর নদের মোংলা বন্দর থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ড্রেজিংয়ে ব্যয় করা ১২৩ কোটি টাকা জলে যেতে বসেছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমইডি। এতে প্রকল্পটির বেশকিছু দুর্বলতা ও ঝুঁকি তুলে আনা হয়েছে।

তথ্যমতে, মোংলা বন্দর থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পশুর চ্যানেল ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বন্দরের ৯নং জেটি থেকে ১৩ কিলোমিটার উজানে ৩৮ লাখ ৮১ হাজার ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের জন্য প্রকল্পটি নেয়া হয়। তবে ড্রেজিং স্পয়েল ফেলার জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হয়নি। ফলে প্রকল্পটির ৪৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়ায় ১২২ কোটি ৭৪ টাকা টাকা। তবে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ ধরা হলেও পরে তা আর এক বছর বাড়ানো হয়। এতে ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়।

যদিও প্রকল্পটির সুফল পুরোপুরি অর্জিত হয়নি বলে মনে করছে আইএমইডি। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড্রেজিংয়ের ফলে মোংলা বন্দরের ৯নং জেটি থেকে উজানে ১৩ কিলোমিটার পর্যন্ত নাব্য অর্জন হয়েছে। তবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার আগে ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় প্রকল্পের সুফল পুরোপুরিভাবে অর্জিত হয়নি। এরই মধ্যে রামপালে নদীর গতিপথ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নদীর অনেক জায়গা মাদার ভেসেল যাওয়া-আসার মতো নাব্য হারিয়েছে। এতে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিং সাপেক্ষে বড় জাহাজ চলাচল করতে পারবে।

এদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা আইএমইডিকে জানান, যে কারণে ড্রেজিং প্রকল্পটির কাজ নেয়া হয়েছিল তার উদ্দেশ্যে পূরণ হচ্ছে না। কারণ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী মালামাল এখন পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। কিছু এলাকায় পলি পড়ার কারণে ভারী মালামাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন করা সম্ভব হবে না। তারা আরও জানান, প্রকল্পের একাংশের কাজ দুই মাসের মধ্যে চালু হবে। এতে ভারী নৌযান চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। কিন্তু এখনও মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিং না হওয়ায় স্থানভেদে নদীর গভীরতায় ভিন্নতা দেখা গেছে, যা কাম্য ছিল না। এতে দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনা পরিকল্পনার মধ্যে অসংলগ্নতা দেখা দিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন চুক্তির ৫.১(ডি)-এর সরাসরি বরখেলাপ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পশুর চ্যানেল ব্যবহারে নিয়মিত মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিংয়ের সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এদিকে ড্রেজিংকৃত এলাকা পরিদর্শনকালে আইএমইডি প্রতিনিধিদল জানতে পারে, পশুর নদ ড্রেজিং করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু জমি ভরাট করা ছাড়াও বন্দরের কিছু জায়গায় এবং বেক্সিমকো ও ডেল্টা গ্যাস কোম্পানির জায়গায় মাটি ফেলা হয়েছে। যদিও ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমি ভরাটের কথা বলা ছিল। এছাড়া বেসরকারি কোম্পানির জায়গা ভরাট করা হলেও এর থেকে অর্জিত অর্থ কোথায় ও ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে কি না, তা প্রকল্প অফিস থেকে জানানো হয়নি।

প্রকল্পটির আরও কিছু দুর্বল দিক তুলে ধরেছে আইএমইডি। এর মধ্যে রয়েছে, ডিপিপি’তে বলা হলেও মাটির ডাইক ও তরজার বেড়া নির্মাণের মাধ্যমে ড্রেজিং স্পয়েল সংরক্ষণ ও রেজিস্টারভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া ড্রেজিং ম্যাটেরিয়ালে বালির আধিক্য ছিল। তাই এগুলো সঠিক জায়গায় না ফেলায় অনেক জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে প্রকল্পটির কয়েকটি ঝুঁকিও চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে, পশুর নদে স্রোত বেড়ে যাওয়ায় তাতে ভাঙনের শঙ্কা বাড়ছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে পশুর নদে পানির প্রবাহ কমে যেতে পারে। এতে চ্যানেল ধরে রাখার মতো প্রবাহ নাও থাকতে পারে।