Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 7:23 pm

জহুরুল ইসলামের চাকরিতে যোগদান

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-২২

 

মিজানুর রহমান শেলী: দেশ বিভাগের সময় জহুরুল ইসলাম মেট্রিকুলেশন পাস করা টগবগে যুবক। দক্ষ-শিক্ষিত লোকের তখন আকাল। জহুরুল ইসলাম দুইবার পরীক্ষা দিয়েও আইএ পাস করতে পারলেন না। অকৃতকার্য হলেন। সংসারে তখন অর্থকড়ি দরকার ছিল। সম্ভ্রান্ত ছিলেন দরিদ্র ছিলেন না, তবে অসচ্ছলতা তাদের ছিল। এ সময় জহুরুলের বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ঠিকাদার। এই ক্ষুদ্র ঠিকাদারি পেশায় যা আয়-ইনকাম হতো তাতে টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে সংসার চলত। তাই জহুরুল ইসলাম চাকরি জীবনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাছাড়া তখন তার মতো মেট্রিকুলেশন পাস করা মুসলিম ছাত্রের জন্য চাকরি পাওয়া কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য সব দিকেই অফুরন্ত সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
পাকিস্তান সরকার যখন শিক্ষিত কর্মী খুঁজছে, জহুরুল ইসলাম তখন চাকরি খুঁজছেন। এই পরিস্থিতি তার চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগকে আরও সহজ করে তোলে। জহুরুল ইসলাম ছোট থেকেই বাবার ঠিকাদারি পেশাকে আগ্রহভরে দেখে এসেছেন। তাই এই পেশায় সবচেয়ে সফলতা প্রাপ্তির স্বপ্ন ও সাধ তারা ছিল। বাবা নিজেও বড় বড় ঠিকাদারদের অনুসরণ করতেন। সে হিসেবে জহুরুল ইসলাম ও তার বাবা আফতাব উদ্দিনের সরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডবিতে চাকরি করাকে একটি সম্মান ও সুযোগ বলে মনে করতেন। যাহোক জহুরুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে সিঅ্যান্ডবিতে (কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং) যোগ দিলেন। তিনি শুরুতে ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেন। এ সময় তার মাসিক বেতন ছিল ৭৭ টাকা ৫০ পয়সা। ১৯৪৮ সালে এই বেতন নি¤œ-মধ্যবিত্তের জন্য কম ছিল না। তবে এই বেতন কাঠামোয় তখনকার জীবন ছিল আদতে টানাপড়েনের। তবুও তিনি এ চাকরি মন দিয়েই করতে থাকলেন।
যাহোক, খুব সুনামের সঙ্গে চাকরি করছিলেন জহুরুল। কিছুদিনের মধ্যেই এই ডিপার্টমেন্টে তার পদোন্নতি হয়। উন্নীত পদের নাম লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। এই পদে উন্নীত হওয়া তার বেতন বাড়ে আড়াই টাকা। অর্থাৎ তার বেতন হলো ৮০ টাকা। এ সময় রাষ্ট্র পাকিস্তানের উন্নয়নে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সাধারণ সবাই মিলে কাজ শুরু করে। একই সঙ্গে তাদের প্রয়োজনেও অবকাঠামো গড়ে উঠতে লাগল। ভারত থেকে আসা বিপুলসংখ্যক মুসলমান এ দেশে এল। ফলে মোট জনসংখ্যার ১০৩ শতাংশ বৃদ্ধি হলো, যে কারণে ঢাকা শহরের ফাঁকা জায়গাসহ শহরতলিতেও নতুন আবাসন গড়ে উঠল। ১৯৪৭ সালের ১৫ দশমিক ৫৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার নগরটি দুই দশকের মধ্য ১৯৬২ সালে ৬৪ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটারে পরিণত হলো।
প্রথমদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দেওয়া হয়। রমনা এলাকার সরকারি ভবনগুলোতে তাদের বন্দোবস্ত করা হলো। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব উন্নয়নের জন্যই সমগ্র নীলক্ষেত এলাকা এবং শাহবাগের কিছু অংশ দখল করে নিল।
১৮৭৬ সালে নবাব আহসান উল্লাহ সার্ভে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ১৯০১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মারা যান এবং তার ছেলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৯০২ সালে পিতার নামানুসারে এটিকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে উন্নীত করেন। সেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ১৯০৫ সালে চার বছর মেয়াদি কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে এটি পূর্ণাঙ্গ স্কুলের মর্যাদা পায় এবং ১৯০৬ সালে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পরে ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার এটিকে ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে। আর ১৯৬২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। এটি দেশের প্রকৌশল শিক্ষার পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছে।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে কামরুন্নেসা স্কুলের সঙ্গে ইডেন স্কুল একীভূত হলো। অন্যদিকে ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেসার উচ্চ মাধ্যমিক শাখা একীভূত হয়ে বর্তমান ইডেন কলেজে পরিণত হয়। ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে আর মুসলিম নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনায় এই নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিল, সেটিকে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বিশাল পরিসরে পরিব্যাপ্ত করা হলো।
আবাসন, যোগাযোগসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে তখন সিঅ্যান্ডবি কাজ করতে থাকে। এ সময় ঢাকা শহরে ৫১১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ৭৭ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রাস্তা ছিল শহর এলাকায়। ৩৩৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয় মফস্বল এলাকায়। সব রাস্তার মধ্যে ৩৩৭ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার ছিল বিটুমিনাস ও সিমেন্ট নির্মিত। বাকি ১৭৩ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার ছিল কাঁচা রাস্তা। মফস্বলের সড়কগুলোর চেয়ে শহরের সড়কগুলো ছিল অনেক উন্নত। শহর অঞ্চলে সিঅ্যান্ডবির সড়কগুলো ছিল ৭৭ দশমিক ৭২ কিলোমিটার। সবগুলো শহুরে পাকা রাস্তা ছিল সিমেন্ট দ্বারা কংক্রিটে নির্মিত। মোট ৪৩টি রাস্তা ছিল এই বিটুমিনাস ও কংক্রিটনির্মিত সড়কের আওতায়। এর মধ্যে টয়েনবি সার্কুলার, মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ (জিন্নাহ এভিনিউ), তোপখানা, আউটার ইনার ও মধ্যবর্তী সার্কুলার, সার্কুলার, ইস্কাটন, বাণিজ্যিক এলাকার সড়কগুলো, আসাদ গেট (আইয়ুব এভিনিউ), বেইলি, মগবাজার, ময়মনসিংহ, সেক্রেটারিয়েট, মিন্টো, নীলক্ষেত, ফুলার, ঢাকেশ্বরী, বকশীবাজার, কলেজ, পিলখানা, দেওয়ান বাজার, অরফানেজ, ফনিক্স, স্টেশন, কালীবাড়ি, শিববাড়ি, পোস্ট অফিস, ঢাকেশ্বরী এবং আজিমপুর ১ নং ও ২ নং, পার্ক, হেয়ার, রমনা, সিটি, রেডিয়াল, স্যাভেজ, সাতমসজিদ, আজিমপুর, গভর্নমেন্ট হাউজ, দিলকুশা, আবদুল গণি, হলি ফ্যামিলি, এলিফ্যান্ট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, সড়ক বাণিজ্যিক এলাকা ও গ্রিন রোড (কুলি রোড)।
এরপর ১৯৪৭ সালে বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে (পিইআর) নামে এর পুনঃনামকরণ করা হয়। ঢাকার ছোট আকারের রেল ইঞ্জিন কামরা ও মালগাড়ি তৈরির কারখানা দেশ বিভাগের পরে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে এর সম্প্রসারণ করা হয়।
চারদিকে একের পর এক উন্নয়নকাজের এই পরিসরে ভালো ঠিকাদারের ছিল অভাব। আবার দক্ষ লোকবলও ছিল না। জহুরুল ইসলাম তখন সিঅ্যান্ডবিতে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি উন্নয়ন বিদ্যার কোনো শাখায়ই শিক্ষিত ছিলেন না। আবার ঠিকাদারি বা ব্যবস্থাপনা বিদ্যায়ও তার কোনো জ্ঞান ছিল না। তবে এই চাকরির সুবাদে তিনি একটু একটু করে জ্ঞান লাভের সুযোগ পেয়ে গেলেন। আবার বিভিন্ন উন্নয়নকাজের টেন্ডার গ্রহণের যাবতীয় সহজ প্রক্রিয়াও তিনি শিখে নেন সহজভাবে। অবশ্য এসব টেন্ডারপ্রাপ্তির জন্য পরিচিতি থাকাটা বাঞ্ছনীয়। সিঅ্যান্ডবির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। এসব সুযোগ তার হাতের নাগালে চলে আসে। তাছাড়া নির্মাণকাজের ভবিষ্যৎ তিনি খুব কাছে থেকেই উপলব্ধি করতে পারেন। এই উপলব্ধি তাকে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গড়নে সহায়ক হতে থাকে।

গবেষক, শেয়ার বিজ