ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-২৪
মিজানুর রহমান শেলী: বংশীয় পেশা, স্থানীয় রীতি কিংবা নিজস্ব ভালো লাগার জায়গা থেকে একেকজন একেক পেশা বেছে নেন। জহুরুল ইসলাম তার জীবনের পেশা জীবনের শুরুতেই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে সাফল্য ছিল। তবুও তিনি পেশা পরিবর্তন করলেন। ব্যবসাকে বেছে নিলেন। এর নানা কারণ থাকতে পারে। তবে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতায় প্রতীয়মান হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা বহুমুখী। এসব কারণের মধ্যে কোনো কোনো কারণ বেশি প্রকট থাকে। জহুরুল ইসলামের জীবনে ঠিক কোন কারণটি প্রাসঙ্গিক হয়েছিল তার ব্যবচ্ছেদ হতে পারে। বস্তুত একজন সফল ব্যবসায় উদ্যোক্তার জীবনেই রয়েছে তরুণদের জন্য শিক্ষা। তার বাবার ছিল ঠিকাদারি ব্যবসা। জহুরুল ইসলামের নিজের ছোটবেলা থেকেই ব্যবসায় জীবনের প্রতি ঝোঁক ছিল। আবার সাতচল্লিশ-পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিÑএই তিনটি ফ্যাক্টরই এ বিবেচনায় অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।
সালটা ১৯৫১। গত আড়াই বছরের চাকরি জীবন শেষে তিনি জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিলেন। সারা জীবন ব্যবসা করবেন। এই জীবন সংগ্রাম তিনি বেছে নিলেন। যাহোক, জহুরুল ইসলামের চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় জীবন বেছে নেওয়া এবং ঠিকাদারি ব্যবসা রপ্ত করে নেওয়ার পেছনের কারণ কিছুটা হলেও অনুমান করা চলে। বস্তুত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে এই আলোচনা যথার্থ হতে পারে: ১. দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা, ২. পৈতৃক পেশা, ৩. চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা।
দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার ধারণাখানি আগের অধ্যায়ে মোটামুটি আলোচনা করা হয়েছে। এটা জহুরুল ইসলামের জীবনে সার্থকতার একটি বড় প্রেক্ষাপট বলে মানতেই হবে। হয়তো আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা অন্য রকম হলে, তিনি তার জীবনে সফল বা স্বার্থক হতেন অন্যভাবে। কিন্তু আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারে। আগের অধ্যায়গুলোর আলোচনায় সুলতান মোগল, কোম্পানি ও ব্রিটিশ আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাজনৈতিক অবস্থার ঘনঘন পরিবর্তন দশা ঢাকাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তার একটি চিত্র আমরা সংক্ষেপে অবলোকন করতে পেরেছি। সে রকম পরিবর্তন দশা ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পরেও যদি এলোমেলোভাবে ঘটত তবে হয়তো জহুরুল ইসলাম তার ব্যবসায় উদ্যোগ হোঁচট খেত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক দশাও বেশি দিন টিকল না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু এ ঘটনা ঘটতে অন্তত ২৩ বছর লেগে গেছে। এই ২৩ বছরে জহুরুল ইসলাম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন।
পাকিস্তানের এই ২৩ বছরে পূর্ব আর পশ্চিমাংশের মধ্যে বেশি বৈষম্য আর বঞ্চনা ছিল। দাবি-দাওয়া, আন্দোলন, সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক পরিবেশও বিরাজ করেছে নিয়ত ধারায়। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও ব্রিটিশ আমলের তৃষিত-শোষিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং বাস্তবায়ন করেছে তার অনেক কিছু। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের লেখ এক ছিল না। অবশ্য এখানে সে আলোচনা বাহুল্য। তাই এ কথা বলতে হবে, তুলনামূলকভাবে ১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত এই পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকার উন্নয়নের যে গতিযাত্রা শুরু করেছিল তা অব্যাহতও ছিল মোটামুটি। একজন ঠিকাদার হিসেবে জহুরুল ইসলাম সেই গতিযাত্রার সফল রথযাত্রী হতে পেরেছিলেন।
১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঢাকার উন্নয়ন দশা বিচার করে তিনি যে ভবিষ্যতের ছক এঁকেছিলেন, তাতে ঢাকার ভবিষ্যৎ অবকাঠামো উন্নয়নের সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে বেশি উৎসাহব্যঞ্জক ও সাহসসঞ্চারী। বলতেই হয় ১৯৫১-পরবর্তী তার দূরদর্শিতা আসলেই ফলপ্রসূ হয়েছিল।
তখন ঢাকেশ্বরী, পলাশী ব্যারাক এবং আজিমপুর এলাকায় সরকারি কোয়ার্টার গড়ে উঠল। ১৯৫৪ সালে নিউমার্কেটের নির্মাণ সম্পন্ন হলো। পুরানা পল্টন থেকে নয়া পল্টন, ইস্কাটন থেকে মগবাজার, সিদ্ধেশ্বরী ও কাকরাইল থেকে রাজারবাগ এবং শান্তিনগর হয়ে কমলাপুর, সেগুনবাগিচাসহ সব এলাকাই দখল হয়ে যায় শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনিক আর আবাসিক অবকাঠামো নির্মাণের ভেতর দিয়ে। এক সময়ের জলাশয় ও নিচু ভূমির মতিঝিল এলাকা ১৯৫৪ সালে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। এ সময়ের মধ্যে নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিংয়ের উত্তর থেকে পুরানা পল্টন পর্যন্ত একটি উš§ুক্ত এলাকা সৃষ্টি হলো। এখানে গড়ে ওঠে স্টেডিয়াম। বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এ বিস্তীর্ণ উš§ুক্ত এলাকাটির পশ্চিম পাশে তৈরি হয় জিন্নাহ এভিনিউ। বর্তমানে তা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রথমবারের মতো জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দুদিকে চলাচলক্ষম রাস্তা তৈরি হলো। অন্যান্য বেশ কিছু রাস্তাও প্রশস্ত করা হলো। এ এলাকায় ষাটের দশকের প্রথম দিকে বায়তুল মোকাররম বা জাতীয় মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো। পাকিস্তান আমলে এ এলাকাটিতে গড়ে ওঠা অন্যান্য আরও কিছু বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভবন। এগুলোর মধ্যে ডিআইটি ভবন, সাততলা আদমজী কোর্ট, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস অফিস, পাকিস্তান রফতানি উন্নয়ন করপোরেশন ভবন উল্লেখযোগ্য।
প্রতিনিয়ত আবাসিক চাহিদা তখন বেড়েই চলেছিল। বেড়ে ওঠা আবাসিক চাহিদা পূরণে সরকারকে তাই ভাবতে হয়েছে। সরকারের এই ভাবনাখানি জহুরুল ইসলাম ধরতে পেরেছিলেন তার সৃজনী ক্ষমতা দিয়ে। সে আলোচনা নিচে আসবে।
যাহোক, ১৯৫৫ সালের পর ধানমন্ডি এলাকাটিকে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হলো। মিরপুর সড়ককে মাঝখানে রেখে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে উঁচু ভূমিতেই একটি আবাসিক বসতি গড়ে ওঠে। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে সরকারিভাবেই মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় অভিবাসী মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বসতি গড়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তেজগাঁও বিমানবন্দর ও তেজগাঁও বাণিজ্য এলাকা সরকারি প্রকল্পের মধ্যে চলে আসে।
ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীরা নিজেদের জায়গা করে নেন। নবগঠিত ইস্পাহানি কলোনি ও বিলালাবাদ তার উপযুক্ত উদাহরণ। এরপরই আসে লেডিস ক্লাব পর্যন্ত বিস্তৃত ইস্কাটন গার্ডেন এলাকাটি। এখানে এক পাশে গড়ে ওঠে ব্যক্তি মালিকাধীন বাড়ি। অন্যদিকে সরকারি ফ্ল্যাট। এর থেকে সামান্য দূরে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। এটি নগরীর আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটায়।
এই একই সময় রাজারবাগ এলাকায় পুলিশদের জন্য এবং শান্তিনগর এলাকায় ডাক ও তার কর্মচারীদের জন্য সরকারি ভবন গড়ে ওঠে। সিদ্বেশ্বরী, কাকরাইল এবং কমলাপুর পর্যন্ত বিশাল এলাকাটি আবাসিক কলোনি দ্বারা সমৃদ্ধ হলো।
২০ শতকের ৫০-এর দশকে ঢাকায় যখন এই উন্নয়নকাজ চলছিল তখন জহুরুল ইসলাম ঠিকাদারি শুরু করেন। অবশ্য তার এই ঠিকাদারি পেশা প্রথমেই অনেক মহীরুহ হয়ে জেগে ওঠেনি। একেবারে ছোট থেকেই তাকে শুরু করতে হয়েছে। সে সময় ঠিকাদারি চালানোর মতো পর্যাপ্ত পুঁজি যে তার ছিল তা বলা চলে না।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ