জহুরুল ইসলামের বেড়ে ওঠা বিরুদ্ধ পরিবেশে

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।   পর্ব-৩

মিজানুর রহমান শেলী: ঢাকার নগরায়নে জহুরুল ইসলামের অবদান ছিল সংগ্রামী। নিজ জীবন ও ব্যবসায় উদ্যোগে ছিল নানা সংকট। পরিবেশ ছিল বিরুদ্ধ। আবার আনুকূল্যও ছিল ঢের বেশি। আরও স্পষ্ট করে বলা চলে, জহুরুল ইসলামের ব্যবসায় উদ্যোগ শুরুর কাল অনুকূলে থাকলেও, জীবনের শুরুর পাঠটি ছিল বিরুদ্ধ পরিস্থিতির নাগপাশে আবদ্ধ। কেননা, ১৯২৮ সালে জহুরুল ইসলামের জš§। চলছিল ইংরেজদের শোষণ। বিশ শতকের এই শুরুর কালে জহুরুলের বাল্যবেলায় ভারতীয়রা একটু একটু করে নিজেদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে চলেছিল: এটা বলা যায়। কিন্তু ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন সূর্য ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী কর্কট রেখায় পরাধীন হয়ে পড়ার পর থেকে বাংলায় যে শুষ্কতা ও বঞ্চনা সৃষ্টি হয়েছিল তারই উনুনপাশে জহুরুল ইসলামের জš§ হয়। এই সময়টিতে বাংলার মানুষের স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠা ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্বভাবতই জহুরুল ইসলামের জীবনটাও ছিল তেমনি এক কষ্টের অধ্যায়। এ সময় তার চাচা ছিলেন এক শিক্ষিত চাকুরে। মানে ওই বিরুদ্ধ পরিবেশে অন্তত একজন প্রাগ্রসর মানুষ। তাই জহুরুল ইসলাম ছোটবেলাতেই চাচার সাহচর্যে

বড় হয়ে ওঠার একটি পরিবেশ  পেয়েছিলেন। তাছাড়া তার দাদা ছিলেন একজন কোরআনের হাফেজÑমানে আদি মুসলিম শিক্ষায় তিনি ছিলেন শিক্ষিত। কিন্তু এই আদি মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে শিক্ষিত কিংবা দিক্ষিত মানুষের জন্য ব্রিটিশ আমল ছিল এক বিরুদ্ধ পরিবেশ। সেসব প্রতিকূলতার ভেতরে কাকার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠার পথ বেছে নেন জহুরুল ইসলাম। কিন্তু পুরোটা ভারতজুড়েই যেখানে ইংরেজ শোষণের জীর্ণতা, সেখানে গতিপথ পরিবর্তন করেও বাঙালি, এমনকি মুসলিমদের জন্য বেড়ে ওঠা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতবাসী স্বাধীনভাবে ব্যবসায় অংশ নিতে পারেনি। তবে তাদের প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তর। এই প্রচেষ্টা প্রায়ই বিদ্রোহে রূপ নেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধারণা ছিল অনেক বেশি রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ধর্মীয় সংসৃষ্টতা তেমনিভাবে জড়িত ছিল না। একচেটিয়া ব্যবসাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারত ছিল তাদের পণ্য উৎপাদনে কাঁচামালের উৎসভূমি এবং প্রধান মুক্ত বাজার। ফলে ব্রিটিশ পুঁজিপতি লগ্নিকারীরা ব্যাংকিং  ও শিপিং খাতে এ দেশের একচেটিয়া ব্যবসায়িক সুবিধাদি দারূণভাবে উপভোগ করতে থাকে। তাছাড়া এখানকার শ্রমবাজার ব্রিটেনের উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিশেষভাবে নজর কাড়ে। তাই তারা তাদের রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থার জন্য এ দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের দিকে উদাসিনতা এমনকি শোষণের নীতি অবলম্বন করে। এ দেশের পোশাকশিল্পের কারিগরদের জন্য তারা উন্নত কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেনি। এমনকি তারা এ দেশের পোশাকশিল্পকে নিরাপত্তা না দিয়ে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

তারা এ দেশে সেনা-বুর্জোয়া শ্রেণি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেনা শোষণের সামাজিক অবয়ব গড়ে তোলে। ফলে সরকারে অর্থনৈতিক বোঝা হালকে হয়। পাশাপাশি জমিদার, পুঁজিপতি ও সদ্য গজে ওঠা পেশাদার সমাজের জন্য একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে ব্রিটেন অর্থনৈতিকভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে, আর এ দেশিরা অর্থনৈতিক জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। প্রাসাদ আর হেরেমখানায় বিলাসী ভোক্তাদের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ল। ফলে ভোক্তা-শ্রেণি বলতে থাকল কেবল সদ্য গজানো উচ্চ শ্রেণি, যারা মসলিন ও ডামাসেন্ড তরবারি ব্যবহার করত না। ফলে ওই সময়ের ভারতে মোগল প্রথানুযায়ী যাবতীয় লগ্নি ধ্বংস হয়ে গেল। সরকার রেল ও কৃষিতে নিজেই উৎপাদনমুখী নানা ধরনের লগ্নি করতে থাকল। ফলে নতুন লগ্নি ও তার ভোক্তা শ্রেণিকে ঘিরে পশ্চিমা ধাঁচের জীবনাচার গড়ে উঠল। নতুন নতুন ইংলিশ স্কুল, শহর-নগরীয় পরিবেশ এবং আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠল। আর পুরোনো ব্যবসায়ী, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানÑএমনকি সমাজ কাঠামো ধ্বংস হতে থাকল। আবার তারা তাদের এ শিক্ষাব্যবস্থা খুব সীমিত পরিসরে গণ্ডিবদ্ধ রাখল। ফলে গ্রাম-সমাজে তেমন কোনো পরিবর্তন বা উন্নয়ন ঘটল না। তারা আরও বেশি অবহেলা আর নির্যাতনের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকল।

২০০ বছরের ব্রিটিশ শোষণ যদি ভারতের ভাগ্যে না জুড়ে বসত তাহলে হয়তো ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত। এক্ষেত্রে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তারা চীনের মতো সামান্য কিছু বিদেশি অংশগ্রহণে নিজস্ব পরিকাঠামো ও শাসনব্যবস্থায় নিজেদের অর্থনীতি চাঙা করত। চীন অপেক্ষা ভারত অনেক বেশি আপনমুখী হওয়ায় হয়তো ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতায় উজ্জীবিত হতো। অথবা ১৮৮০’র পরই যদি ভারত স্বাধীনভাবে চলতে পারত, তবে তাদের ক্রমবর্ধমান জনশক্তি মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই চলতে পারত। সামান্য কিছু অর্থ বিদেশে যেতে, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক মিল-কারখানার উন্নয়ন ঘটত। যেটা ১৯৪৭’র পরে ঘটেছে।

যাহোক, প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ্রমিকদের সমীচীন বেতন দিত। এমনকি এই বেতন কাঠামো মাঝে মাঝে বৃদ্ধির একটি ব্যবস্থাও চালু ছিল। ফলে সাধারণের হাতে পুঁজি গড়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু তাদের এ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল যখন তারা বাংলায় আগমন করে। বাংলায় এসে দেখল লাভের বেশিরভাগ অংশ জনগণের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে আর সামান্য অংশ কোম্পানির পকেটে উঠছে। এর ফলে যেটা দেখা যায়, তাহলো গ্রাম্য জনসাধারণের ভেতরে বিদ্রোহের শক্তি দানা বাঁধছে।

এরকম পরিস্থিতিতে লর্ড ক্লাইভ কোম্পানির হাতে মূল শক্তিটা রেখে নবাবদের পুতুল সরকার হিসেবে জিইয়ে রাখলেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিং নবাবদের উৎখাত করে সরাসরি সর্বময় ক্ষমতা অধিকার করলেন।

১৭৮৫ সালে কর্নওয়ালেস বেঙ্গলে একটি পেশাদার ক্যাডার গড়ে তুললেন যারা একটি সম্মানজনক বেতন পেত, পেনশন ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুযোগও রাখলেন, কিন্তু বেসরকারি বাণিজ্য ও উৎপাদনে তাদের সব সুযোগ বন্ধ করে দিলেন। তিনি বেঙ্গলে সরকারের উঁচু উঁচু পদে ব্রিটিশদের বসিয়ে আশপাশের ছোট পদে রাখলেন ভারতীয়দের। বিচারক হিসেবে ব্রিটিশদের নিয়োগ দিলেন; ব্রিটিশরাই রাজস্ব আদায়কারী ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে স্থান পেলেন।

যাহোক, উপযোগবাদীরা ‘হতে দাও’ নীতির শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধিতা করত। তাই তারা দুর্ভিক্ষের মতো সংকট সমাধানে বাজার ব্যবস্থার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করতেন। এমনকি তারা কৃষিকে শক্তিশালী করা বা শিল্প খাতের কণ্ঠ চেপে ধরার নীতি অবলম্বন করেনি। এই ‘হতে দাও’ নীতিটি মূলত ভারতীয় সিভিল সার্ভিসদের মাঝেই লালিত হতো, কিন্তু ব্রিটিশদের এ ব্যাপারে কোনো সমর্থন ছিল না। তারা এই নীতির জোর দাবি ১৯২০ সাল পর্যন্ত চালু রাখে। কিন্তু কোনো সুফল বয়ে আসেনি।

তখনকার প্রশাসন ছিল অনেক দক্ষ ও স্বচ্ছ, কিন্তু কিছু বিষয়ে তারা ছিলেন অনেক পক্ষপাত দৃষ্টিসম্পন্ন। তারা কিছুমাত্র ক্ষেত্রেই উন্নয়নের নীতি চালু রেখেছিল। যেমন ১৯৩৬ সালে সরকারি খাতের অর্ধেকের বেশি অংশ খরচ করেছিল সেনা, বিচার, পুলিশ ও কারাগারের উন্নয়নের জন্য। এমনকি মাত্র ৩ শতাংশের কম কৃষি উন্নয়ন খাতে ব্যয় করে।

এ পরিবেশেই জহুরুল ইসলামের শৈশব কেটেছে। ভাগলপুরের গ্রাম্য পরিবেশের কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোতে খুব ক্লান্তিকর পরিস্থিতি পার করেছিল তিনি। জহুরুল ইসলামের দাদা বা তার পূর্বপুরুষদের এসব কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে বাবা আফতাব উদ্দিন ও চাচারা ভিন্ন পেশা ও সংস্কৃতির দিকে মন দেন। তারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। বাবা আফতাব উদ্দিন ছোটখাটো ঠিকাদারি পেশায় নিয়োজিত হতে থাকেন। কিন্তু সেই আর্থিক পরিপ্রেক্ষিতটা সম্ভাবনাময়ী ছিল না। তাই বাবার একান্নবর্তী পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল নিত্যদিনের হাঁসফাঁস। জহুরুল ইসলাম বাবার সেই জীবন সংগ্রাম দেখতে দেখতে বড় হতে থাকেন। এই সংগ্রামী জীবন জহুরুলকে অনেক বড় কীর্তিকর্মের পথ দেখিয়েছিল।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০