জাকাত ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে, তবে গরিব-দুস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তির দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ ও জাকাত শুধু শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনে জাকাত শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। নামাজের পর সবচেয়ে বেশিবার এটি উল্লেখ করা হয়েছে।
রমজান মাসে রোজা পালন করলে যেমন সারা শরীর পবিত্র হয়ে যায়, তেমনি মাহে রমজানে জাকাত আদায় করলে মানুষের উপার্জিত সব সম্পদ পবিত্র হয় এবং অধিক সওয়াব হাসিল করা যায়। সিয়াম পালন করে রোজাদাররা পরস্পরের প্রতি সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। ফলে বিত্তবানরা দান-সদকা ও জাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত হন। রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি হাসিল হয়। যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একটি নফল ইবাদত করেন, তবে তিনি মাহে রমজানে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবেন। যিনি একটি ফরজ আদায় করবেন, তিনি অন্যান্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব পাবেন।
স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়ে থাকে। যেমন:
১. সম্পদের ওপর পূর্ণ মালিকানা: সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকানা সুনির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সম্পদ মালিকের অধিকারে থাকা, সম্পদের ওপর অন্যের অধিকার বা মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামতো সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার থাকা। ওয়াক্?ফ করা সম্পদ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোত্রের জন্য হয়, তবে তার ওপর জাকাত দিতে হবে।
২. সম্পদ উৎপাদনক্ষম হওয়া: জাকাতের জন্য সম্পদকে অবশ্যই উৎপাদনক্ষম, প্রবৃদ্ধিশীল হতে হবে; অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতাই যথেষ্ট। যেমন: গরু, মহিষ, ব্যবসার পণ্য, নগদ অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কেনা যন্ত্রপাতি প্রভৃতি।
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ: জাকাত ফরজ হওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে শরিয়ত নির্ধারিত সীমাতিরিক্ত সম্পদ থাকা। সাধারণ ৫২.৫ তোলা রুপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা উভয়টি মিলে ৫২.৫ তোলা রুপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে সে সম্পদের জাকাত দিতে হয়।
৪. মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকা: সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে যে সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকবে, শুধু তার ওপরই জাকাত ফরজ হবে। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে উল্লেখ আছে:
লোকজন আপনার কাছে (মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে) জানতে চায়, তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? বলুন, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আল্লাহ এভাবেই তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধান বলে দেন।
৫. ঋণমুক্ততা: নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলেও ব্যক্তির ঋণমুক্ততা জাকাত হওয়ার অন্যতম শর্ত। যদি সম্পদের মালিক এত পরিমাণ ঋণগ্রস্ত হন, যা নিসাব পরিমাণ সম্পদও মেটাতে অক্ষম বা নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার চেয়ে কম হয়, তার ওপর জাকাত ফরজ হবে না। ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত দিতে হবে।
৬. সম্পদ এক বছর আয়ত্তাধীন থাকা : নিসাব পরিমাণ স্বীয় সম্পদ এক বছর নিজ আয়ত্তাধীন থাকলে জাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বশর্ত।
জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়, বরং গরিবের ন্যায্য অধিকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের অধিকার’। (সুরা জারিয়াত, আয়াত ১৯) জাকাত আদায় করলে ধন-সম্পদ কমে না, বরং আল্লাহ এতে অনেক বরকত দান করেন এবং তা বহুগুণ বেড়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন, ‘জাকাত কেবল ফকির, মিসকিন ও জাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন, তাদের জন্য; অর্থাৎ নও মুসলিম, দাসমুক্তির জন্য, ঋণে জর্জরিত ব্যক্তিদের ঋণমুক্তির জন্য, আল্লাহ পাকের রাস্তায় জিহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহ পাকের নির্ধারিত বিধান এবং তিনি সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তওবা: আয়াত ৬০)
মুহাম্মদ আকিল নবী