জাতির অগ্রযাত্রায় অন্তরায় কোটাব্যবস্থা

মো. আব্দুন নূর : ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের পাঁচটি দাবি নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করে। প্রথম দাবি ছিল, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা থেকে ১০ শতাংশ করা। শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিল চায়নি, যুগোপযোগী কোটা সংস্কার চেয়েছিল। শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে সরকার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার না করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। কোটাব্যবস্থা সংস্কার না করে তা একেবারে বাতিল করা সরকারের বোকামি বা চালাকি হলেও মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের বুকে এঁকেছিল। আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বহাল থাকবে, হাইকোর্টের এই অদূরদর্শী রায়ে মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি জয় করার শিক্ষিত তরুণদের স্বপ্ন ম্লান হয়ে গেল।

এই সিদ্ধান্ত চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে হতাশা সৃষ্টি করবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশে বেকারত্বের প্রকট সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তরুণরা দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে রঙিন স্বপ্ন বোনে। আবার কোটাব্যবস্থা বহাল রাখার রায়ের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত চাকরিপ্রত্যাশীদের অবজ্ঞা করা কতটুকু যৌক্তিক, তা বিবেচনার বিষয়। সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সবার সমান সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও আজকের উন্নয়নশীল দেশে কোটাব্যবস্থার নামে শ্রেণিবৈষম্য সমীচীন নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় হলের অবাসযোগ্য গণরুমে বাস করে হলের ডাইনিংয়ের পুষ্টিহীন খাবার জোরে গলাধঃকরণ করে উচ্চশিক্ষার পাঠ চুকানো তরুণদের পাপ নয়। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কবলে পড়ে যে সময়ে কোনো শিক্ষার্থী অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে, সেসময় নামমাত্র অল্পশিক্ষিত তরুণ ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় এবং স্বল্প পুঁজির নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়ে সংসার করে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করে। আর শিক্ষিত বেকার তরুণ দেশের হাল ধরার জন্য খেয়ে না খেয়ে নির্ঘুম স্বপ্ন দেখে দিনাতিপাত করে। আজ এই শিক্ষিত তরুণদের সঙ্গেই কোটাব্যবস্থার নামে প্রহসন! এই রায় কাঠের চশমায় অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণের ওপর অত্যাচার মনে না হলেও তা জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যজনক। আক্ষেপ জাগে, এই জাতি বুঝি একুশ শতকে পদার্পণ করেও তরুণের তারুণ্যকে দু’চোখে সম্মান দিতে শেখেনি।

রাষ্ট্র যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের আংশিক মূল্যায়নও করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের উচিত জেলায় জেলায় নামমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রকল্প হাতে না নেয়া। রাষ্ট্র যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে উচ্চশিক্ষার নামে নাটক শুরু করেছে। বিআইবিএসের তথ্যমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। এত তরুণকে জোর করে উচ্চশিক্ষার নামে বেকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার রহস্যটা কী? বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এত বেকার উৎপাদনের কারখানা? এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান? উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না হলে তরুণরা না খেয়ে মরবে না, বরং বেঁচে যাবে। বিবিএসের তথ্যমতে, যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। মাধ্যমিক শেষ করা বেকার ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করা বেকারের হার ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর উচ্চশিক্ষা অর্জন করা বেকারের হার উল্লেখ করতে বুকে খুব বাধে। এই অসহায়-নিরুপায় শিক্ষিত বেকারদের ওপরই আবার কোটাব্যবস্থার নামে অত্যাচার! তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে পারে না। একটা বুলি প্রায়ই শুনিÑদক্ষতার অভাবে নাকি অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছে। এই ফাঁকা বুলি ছুড়ে শিক্ষিত তরুণদের দোষারোপ করা ধৃষ্টতার নামান্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে যদি তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তোলতে না পার, তাহলে রাষ্ট্র তুমি এখনও ঘুমের ঘোরেই আছ, তোমার গা ছোঁয়ার সৌভাগ্য এখনও একুশ শতকের বাতাসের হয়নি। অযথা কোটাব্যবস্থা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শিক্ষিত তরুণদের দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তুলে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের চিন্তা করা উচিত। তা না হলে তরুণরা হতাশায় তলিয়ে গেলে দেশের উন্নয়নও অতলে তলিয়ে যাবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও ত্যাগ অস্বীকার করার মতো অকৃতজ্ঞতা ও দুঃসাহস কারও নেই। কিন্তু কোটাব্যবস্থা তাদের সন্তানদের সম্মানিত করার একমাত্র উপায় নয়। শিক্ষিত তরুণদের মাঝে কোটার মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্যের দেয়াল না তোলে, আগামী সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গড়ার লক্ষ্যে তাদের দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে। যথাযথ দক্ষতা অর্জনের জন্য তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দিতে হবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।

শিক্ষার্থী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০