অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে গতকাল। বইপ্রেমী জ্ঞানপিপাসুদের অনেকেই বই সংগ্রহ করেন বইমেলা থেকে। অন্য সব পণ্যের মতো বইও কমবেশি বিক্রি হয় সারা বছর। কিন্তু ফেব্রুয়ারি এলে বই কেনেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। বইমেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তারা। সত্যি বলতে বই কেনার সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় বইমেলার অবদান অনস্বীকার্য।
মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা যে মেলার বীজ বপন করেছিলেন, সেটি ফুলে-ফলে এখন এক বিশাল মহিরুহ। একুশের বইমেলা মানে পুরো মাসজুড়েই সৃজনশীল বই প্রকাশনা। লেখক, প্রকাশক, পাঠক সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এ বইমেলার জন্য। ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে।
বইমেলায় আসেন সব মত ও পথের সব বয়সী মানুষ। একুশের মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। এটি প্রকাশনা শিল্প, লেখক-পাঠক কারও জন্যই শুভকর নয়। সারা বছর ধরে বইয়ের প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে এ মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
খ্যাতনামা প্রকাশক ছাড়াও অপেশাদারি প্রকাশকরাও মেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করেন। মন্দ দিক হলো মেলায় বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সে হারে মান বাড়ছে না। কোনো প্রকাশক কেবলই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য যেনতেনভাবে বই প্রকাশ করেন। সেখানে সৃজনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা নেই। ফলে মানহীন বই, ভুল বানান, তথ্য ও মুদ্রণত্রুটিযুক্ত বই প্রকাশনা শিল্প, লেখক, ক্রেতা, পাঠক সবার জন্যই ক্ষতিকরই নয় সৃজনশীলতায় বড় বাধা। সারা বছর বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা গেলে কোনো বিশেষ সময়ে বই প্রকাশের বাড়তি চাপ থেকে লেখক, প্রকাশক সবাই মুক্ত থাকতে পারবেন। তখন প্রকাশনার প্রতি যথাযথ মনোযোগ এবং যত্নবান হওয়ার আবহ সৃষ্টি হবে।
অমর একুশের চেতনাসঞ্জাত একুশে বইমেলা মেলার শ্রীবৃদ্ধি কীভাবে করা যায়, তা আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। যাদের আমরা পছন্দ করি না, তাদের মোকাবিলায় বই হোক বড় হাতিয়ার। যুুক্তিনির্ভর মন-মনন তৈরিতে বইমেলার বিকল্প নেই। সময়ের অভিঘাতে মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পাল্টাচ্ছে। তাই ভিন্নমতের প্রকাশনাকেও স্থান দিতে হবে বইমেলায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় স্টল দেয়া কিংবা না দেয়া বইমেলার সর্বজনীনতাকে নষ্ট করে। যাদের নিয়মিত প্রকাশনা নেই অথচ স্টল পেল; এমন যেন না হয়।
‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।…
অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। আবহমানকাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তš§ধ্যে অমর একুশে বইমেলা হলো সর্বোৎকৃষ্ট মেলা; যেখানে জ্ঞানের বিনিময় ঘটে বইয়ের মাধ্যমে। একটি আলোকিত জাতি গঠনে মানুষের জাগতিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, দার্শনিক বিকাশে বইমেলা সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত রাখুকÑএই প্রত্যাশা।