দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ গঠিত হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ এবং এতদুদ্দেশ্যে-শান্তিভঙ্গের হুমকি নিবারণ ও দূরীকরণের জন্য এবং আক্রমণ অথবা অন্যান্য শান্তিভঙ্গকর কার্যকলাপ দমনের জন্য কার্যকর যৌথ কর্মপন্থা গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে আন্তর্জাতিক বিরোধ বা শান্তিভঙ্গের আশঙ্কাপূর্ণ পরিস্থিতির নিষ্পত্তি বা সমাধান। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা মানবিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিকাশ সাধন এবং মানবিক অধিকার ও জাতিগোষ্ঠী, স্ত্রী-পুরুষ, ভাষা বা ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মৌল স্বাধিকার সমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উৎসাহ দান ইত্যাদি।
৫১টি দেশ নিয়ে তৈরি হওয়া সংস্থাটির বর্তমান সদস্য দেশ ১৯৩টি। জাতিসংঘের প্রধান শাখা ছয়টি। যার মধ্যে তিনটি শাখাকে মনে করা হয় সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। এগুলো হলোÑসাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ ও সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয়।
জাতিসংঘ সনদ গঠনের সময় তারা দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করেন, ভবিষ্যৎ বংশধরদের যুদ্ধের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য, যে অভিশাপ আমাদের জীবনকালে দুইবার মানব জাতির নিকট অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা বহন করে এনেছে এবং মৌল মানবিক অধিকার, মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং ছোট-বড় জাতি ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করার জন্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন উৎস প্রসূত বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান বজায় রাখার মতো অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য এবং ব্যাপকতর স্বাধিকারের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতি সাধন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য এবং এতদুদ্দেশ্যে-পরস্পর সুপ্রতিবেশী হিসেবে শান্তিতে বসবাস ও সহিষ্ণুতার অনুশীলন করতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য আমাদের শক্তি সংহত করতে। সাধারণ স্বার্থ ব্যতীত যে সামরিক শক্তি ব্যবহার করা হবে না। এ বিষয় নীতি গ্রহণ ও পদ্ধতিগত ব্যবস্থার মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে এবং সকল জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করতে উল্লিখিত উদ্দেশ্যসমূহ চরিতার্থ করার জন্য জাতিসংঘ গঠিত হয়।
অতএব, যথাযথরূপে যারা তাদের পূর্ণক্ষমতা পত্র প্রদর্শন করেছেন, সানফ্রান্সিসকো নগরীতে সমবেত সেই প্রতিনিধিবর্গের মাধ্যমে জাতিসংঘ তাদের নিয়ে স্থাপিত হয়েছে।
অথচ দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘ যে উদ্দেশ্য গঠিত সেটাই এখন পালন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে নিয়েই জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত নানা দেশের নানা মতবিরোধ ইতোমধ্যে দেখা যায়। জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও খুব একটা পরিস্থিতি সামালের ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে ফলোপ্রসূ কোনো সমাধান করতে পারেননি।
ধর্মীয় গ্রন্থের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছে। তাতে এ ধরনের ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ জুলাই ২০২৩ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ‘আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ এবং ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রতিরোধে সহনশীলতা প্রসার’ শীর্ষক সভায় মরক্কোর উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়, এটি ধর্ম বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে যেকোনো ব্যক্তি, ধর্মীয় প্রতীক, পবিত্র গ্রন্থ, বাড়ি, ব্যবসা, সম্পত্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, উপাসনার স্থানের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংস কার্যক্রম নিন্দনীয়। তাছাড়া উপাসনাস্থলের ওপর সব ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। কিন্তু স্পেনের প্রতিনিধি ধর্মীয় প্রতীক ও গ্রন্থের অবমাননাকে ঘৃণ্য কাজ মনে করলেও তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের শামিল নয় বলে মতামত দেন। তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি বাদ দেয়ার প্রস্তাব জানান। অপরদিকে ডেনমার্কের প্রতিনিধি জানান, কোরআন বা অন্য যেকোনো ধর্মীয় গ্রন্থ পোড়ানো খুবই ঘৃণ্য অসম্মানজনক কাজ। তার পক্ষে এ ধরনের কাজগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানায়। তবে তার দেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনাকে নিষিদ্ধ করে না। তাই এসব আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের শামিল নয়। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার বন্ধ করুন। নীরবতার মানে সম্মতি দেয়া।
ইতোমধ্যে সুইডেন ও ডেনমার্কে কোরআন পোড়ানোর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’র যুক্তি দিয়ে এ কাজের অনুমতি দেন সুইডেনের একটি আদালত। অবশ্য মুসলিম দেশগুলোর তীব্র নিন্দার মুখে ঘটনার চার দিন পর সুইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনাকে ‘ইসলামবিদ্বেষ’ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানায়।
সুইডেনে কোরআন পোড়ানো ও তা নিয়ে মুসলিম দেশগুলোয় ?সৃষ্ট ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির বিরোধিতায় একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে (ইউএনএইচআরসি)। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক ইউএনএইচআরসিকে বলেছেন, মুসলমানদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম বা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড ভুল, আপত্তিকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন।
জাতিসংঘকে সৃষ্টির যে মহান উদ্দেশ্য তা আজ পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো অবমাননার চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তা আমরা এসব ধর্মীয় অবমাননা, ইউক্রেন-রাশিয়া, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধকে পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাই। এ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে আমাদের এ প্রশ্ন থেকেই যায়, বিশ্বে কি তবে জাতিসংঘ সনদের অবমাননা ঘটছে?
তামান্না ইসলাম
শিক্ষার্থী, আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়