জাতীয় অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর প্রভাব

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি নিন্মমধ্যম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশ সাহসিকতায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের।

দেশের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে দুটি বড় নদী। দক্ষিণাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করেছে পদ্মা এবং উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করেছে যমুনা। পদ্মা সেতুর কারণে এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোয় চলে এসেছে। দেশের সবচেয়ে বেশি ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করে কক্সবাজারে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগত। এর চেয়ে কম দূরত্ব হওয়ার পরও সড়ক বা নৌপথে কুয়াকাটা পৌঁছাতে সময় লাগত একই রকম সময় বা তার চেয়ে বেশি। বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ায় সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পৌঁছাতে সময় লাগবে ছয় ঘণ্টা। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটন বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এর ফলে দারিদ্র্য কমবে এবং যাত্রীদের সময় ও অর্থ বাঁচবে। দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে যুক্ত হবে। পদ্মা সেতুর কারণে বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান হবে।

দক্ষিণাঞ্চলে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশের বাস। বিচ্ছিন্ন থাকায় এই অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার সারাদেশের গড় হার থেকে পাঁচ শতাংশ বেশি। সেতুর কারণে যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হলে এই অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার প্রতিবছর ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হারে কমবে, যার ফলে সারাদেশে দারিদ্র্য কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। এরই মধ্যে সেতু ঘিরে সংযোগ সড়কে দুই ধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান। ২০০৭-২০০৮ সালে জাজিরা প্রান্তে প্রতি শতাংশ জমির দাম ছিল সাত হাজার ১৫৪ টাকা। আজকের দিনে এক শতাংশ জমির দাম ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এটা বর্তমান সময়ের সরকারি দাম। বাস্তবে এই দাম দু-তিনগুণেরও বেশি। অর্ধশতাব্দী ধরে চলা নৌ-সিন্ডিকেট পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। সেতু থেকে আদায়কৃত পুরো টোলটাই পাবে সরকার। সবমিলিয়ে বিলিয়ন ডলারের মতো সরকারি খাতায় যোগ হবে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের জন্য বিশাল অঞ্চলজুড়ে নদীশাসন করা হচ্ছে, যার ফলে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ৯ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। ফলে বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে নদীশাসনে থাকা বিশাল অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। সারাবিশ্বের যেকোনো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ রিটার্ন এলে সেটিকে আদর্শ ধরা হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে জাইকা (জাপানি ইন্টারন্যাশনাল কো অপারেশন এজেন্সি) ২০০৯ সালে এক সমীক্ষায় দেখায়, এখান থেকে ইকোনমিক রিটার্ন উঠে আসবে ১৮-২২ শতাংশেরও বেশি। বিশাল এই রিটার্ন আয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে কৃষি, বাকি অংশজুড়ে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও পর্যটন। পদ্মা সেতুর ফলে এটি দাঁড়াবে ছয়-সাত শতাংশেরও কিছু বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑসরকারি অর্থায়নে বিশাল এই খরচ কত বছরে উঠে আসবে? এক্ষেত্রে যমুনা সেতুকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। যমুনা সেতুতে খরচ হয় তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এই অর্থ উঠে আসতে ২৫ বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ২০ বছরেই এ সেতু থেকে উঠে আসে পাঁচ হাজার ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বিনিয়োগের টাকা এত দ্রুত উঠে আসা অর্থনৈতিক সুবাতাসকেই নিশ্চিত করে। পদ্মা সেতু সেদিক থেকে খুবই সম্ভাবনাময়। পদ্মা সেতুতে খরচ হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর পুরো অর্থ উঠিয়ে আনার জন্য ৩৫ বছর সময় ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের সংযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগÑএসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের  গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হবে পদ্মা সেতু।

যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগÑএই তিনটির সার্থক সমন্বয়ই পদ্মা সেতুকে অর্থনৈতিক করিডোরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে পারে। বেকাররা কাজের জন্য রাজধানীমুখী না হয়ে স্থানীয়ভাবে কৃষি খাতে সংযুক্ত হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেইসঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহেও নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা বদলে দেবে তা নয়, বরং এই সেতু গোটা দেশের অর্থনীতিকেই বদলে দেবে।

ফাতেমা তুজ জোহরা

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০