সুশান্ত সিনহা:হয়নি হয়নি করেও গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণে আইনি সংস্কারসহ বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সার্বিকভাবে খুব একটা অগ্রগতি নেই। আইন-বিধিগুলো বাস্তবায়নে এখনও বেশ খানিকটা দুর্বলতা রয়েছে। সিগারেট-বিড়ি-জর্দা-গুল কোম্পানিগুলোর বিরামহীন মুনাফা অর্জনের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’কে জিইয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত কোম্পানিগুলো বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে আসছে। নীতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপের পাশাপাশি বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো ছলে-বলে-কৌশলে ও আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বাড়তি মুনাফা করছে বছরের পর বছর ধরে। আর এজন্য তারা কিছু মিথ তৈরি করে সুকৌশলে প্রচার-প্রচারণা চালায়। এতে শুধু নীতিনির্ধারকই নয়, সাধারণ ভোক্তাতো বটেই, কখনও কখনও তামাক নিয়ন্ত্রণে যুক্ত কিছু কিছু মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ফলে তামাক কোম্পানি সৃষ্ট মিথগুলো ভাঙতে না পারলে কার্যকর তামাকের কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং দিন শেষে ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া বেশ কঠিন হবে। ফলে তামাক কোম্পানিগুলোর কূটকৌশলসম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি।
মিথ ১ : সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছড়িয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি!
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি যেমন বড় হতে পারে না, তেমনি আইন ও বিধির চেয়ে প্রজ্ঞাপন বড় হতে পারে না। আর আইন ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। আবার সময়ের প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত কাটছাঁট বা সংশোধন করার জন্য এসআরও জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তা মূল আইন ও বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আইনই সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয় যা সংসদে পাসকৃত। মূল সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা ৫৮ এর উপ-ধারা (২) এ বলা হয়েছে,
‘উক্ত বিশেষ পরিকল্প দ্বারা বোর্ড উক্ত পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিবে এবং উক্ত মূল্য মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য হিসাবে গণ্য হইবে।’
আইনের এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ২০১৯ সালের ১৩ জুন জারিকৃত, উৎপাদন বা আমদানিকৃত তামাকযুক্ত সিগারেটের মূল্য নির্ধারণসহ উহার প্যাকেটে স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ব্যবহার পদ্ধতি বিধিমালা, ২০১৯ এর বিধি ৫ এর উপ-বিধি(১) এ সিগারেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে আইন ও বিধিতে সিগারেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপি লেখার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু পরে ২০২২ সালের ১ জুন জারিকৃত এসআরও-মূসক-১৭০ এর মাধ্যমে সংশোধনিতে টেবিলে স্তরভিত্তিক সিগারেট, বিড়ি, জর্দা এবং গুলের দামের ক্ষেত্রে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দটা ফেলে দিয়ে শুধু খুচরা মূল্য লেখা হয়েছে। এটা যে বড় তামাক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপে কৌশলে সর্বোচ্চ শব্দটা ফেলে দেয়া হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সেই রূপকথার গল্পের মতোই ‘বারো হাত বাকুঁড়ের তেরো হাত বিচি’র মতো বাংলাদেশেও সিগারেটে কোম্পানিগুলো আইন ও বিধির নির্দেশনা ভেঙে প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য না লিখে শুধু খুচরা মূল্য লিখছে। বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলোর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য না লেখার যে ব্যাখা দিয়েছে তাও রীতিমতো হাস্যকর এবং আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। করযুক্ত পণ্যে সব সময়ই ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস-এমআরপি বা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকে এবং ক্রেতা-গ্রাহকরা সেই দামেই পণ্যটি কেনে। নেপাল, ভারত, পাকিস্তানসহ সবখানেই সিগারেটের প্যাকেটে এমআরপি মূল্য লেখা থাকে। বাংলাদেশেও অন্য সব পণ্যে এমআরপি লেখা থাকলেও শুধু সিগারেটের ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। আর এই একটি শব্দের কারণে প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে বাড়তি আদায় করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। সিগারেটের প্যাকেট মুদ্রিত মূল্যের চেয়ে বাড়তি দামে নেয়া সংক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ-বিইআরের গবেষণার তথ্য উপাত্ত এবং বাজার দরের তুলনামূলক তথ্য নিয়ে গত ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল একাত্তর টেলিভিশনে। ‘দৈনিক ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদন পরে আমলে নিয়ে তদন্তে নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট-এলটিইউ। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, জাপান টোব্যাকোসহ প্রধান তিনটি সিগারেট কোম্পানি মূসক-শুল্ক প্রদানসহ যাবতীয় কিছু তত্ত্বাবধান করে থাকে এলটিইউটি। তাদের সেই তদন্ত ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও যুক্ত ছিল। তদন্তে আমার সংবাদের সত্যতা পাওয়ায় ‘দৈনিক ২০ কোটি টাকা বাড়তি নিচ্ছে’ শিরোনামে ২০২২ সালের ২১ আগস্টে প্রতিবেদন এনবিআর। যা তুলে ধরে দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকায় ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। যা নিয়ে পরে একাত্তর টেলিভিশনেও তুলে ধরি।
মিথ ২: জেনে বুঝে আইন লঙ্ঘনে খোঁড়া অজুহাত কোম্পানির
বাংলাদেশের সিংহভাগ সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড। প্যাকেটের উল্লেখিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএটিবি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে জানিয়েছে যে, ‘প্যাকেটের গায়ের মুদ্রিত মূল্য হলো খুচরা বিক্রেতার ক্রয় মূল্য।’ এটা যে ডাহা মিথ্যা কথা এবং কোম্পানির ছলচাতুরি তাও ওই সভায় স্পষ্ট করেছে এনবিআর ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচ্য সূচি ৩ এর শুরুতে বলা হয়, ‘আলোচনার এ পর্যায়ে সভাপতি উল্লেখ করেন যে, পূর্বোক্ত সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্তরভিত্তিক উপকরণের নাম ও ব্যবহারের পরিমাণসহ প্রফিট মার্জিন উল্লেখ করে এ দপ্তরে মূল্য ঘোষণা (পরিশিষ্ট-ক) দাখিল করে। ওই পরিশিষ্ট-ক তে ঞৎধফব গধৎমরহও অর্ন্তভুক্ত তাকে। ফলে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রয় করার সুযোগ নেই।’
দুঃখজনক দিক হলো এই দেশে গবেষক ও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মূসক আইন-বিধি-বিধান বিষয়টি অগ্রাহ্য করে কোম্পানির গোঁজামিলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাদের প্রস্তাবে পরোক্ষভাবে তামাক কোম্পানির ছড়ানো বিভ্রান্তির সুর ধ্বনিত হয়। অনেকেই আবার বলেন, এমআরপি মানে ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস নয়, ওটা মিনিমাম রিটেল প্রাইস। দুনিয়া জোড়ায় এমআরপি মানেই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য। কেউ কেউ বলেন, প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি হলে হোক, দাম বেশি হলেই তো ভোক্তা-ক্রেতাদের পকেটে টান পড়বে। খাওয়া কমিয়ে দেবে তাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ হবে ইত্যাদি। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হয় তখনই যখন দেখি তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্দোলনরত কর্মী ও সংগঠনও এ ধরনের মতামত পোষণ করে এবং কোম্পানি বিভ্রান্তিমূলক ভাষায় প্রস্তাব ও প্রেস রিলিজ পাঠায়। বাড়তি দামে সিগারেটে বিক্রি করা অবৈধ। ফলে অবৈধ কোনো কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃত দেয়ার সুযোগ নেই আমাদের। দ্বিতীয়ত, সিগারেট কোম্পানি যখন এমআরপির চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করবে তখন তার নির্ধারিত ট্রেড মার্জিন ব্যয়ের বদলে পুরোটায় আয় তথা মুনাফায় যোগ হবে। প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা করে বছরে ৭ হাজার কোটি বাড়তি আদায় করলে এই অবৈধ আয় দিয়েই সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রভাব বিস্তার করবে। অনেকটা কৈ এর তেলে কৈ ভাজবে। তাই সিগারেটের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার জন্য নির্ধারিত কমিশনের (যা প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত দামের মধ্যে ধরা আছে) টাকাটা ছাড় দিলে কোম্পানির ব্যয় বাড়তো, ফলে তাদের মুনাফা কমতো। উদাহরণ স্বরূপ, এক প্যাকেট লেক্সাস বিস্কুটের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা ৫ টাকা এবং দোকানিরা তা ৫ টাকায় বিক্রি করছে কারণ তাদের ক্রয়মূল্য ৪ টাকা। অর্থাৎ তারা মুদ্রিত দামের চেয়ে ১ টাকা কমে কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে পারে বলেই গায়ের রেটেই বিক্রি করে মুনাফা থাকে খুচরা দোকানির। সব পণ্যের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম হলেও ব্যতিক্রম শুধু সিগারেট কোম্পানির ক্ষেত্রে। তাই এমআরপির দামে সিগারেট বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করা দুই কারণে জরুরি, প্রথমত, ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় ও রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ হবে। দ্বিতীয়ত, সিগারেট কোম্পানির পাইকারি ও খুচরা দোকানিদের কমিশনের টাকাগুলো দিয়ে দিলেই (বর্তমানে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সেই কমিশনের টাকা দেয়া সিগারেট কোম্পানিগুলো) তাদের মানুফা কমবে অনেকাংশে। আর মুনাফা কমলে এমনিতেই তখন সিগারেট কোম্পানিই আগ বাড়িয়ে সিগারেট দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে।
আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তাহলো করভারের বিষয়টি। বর্তমানে সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক-এসডি, মূল্য সংযোজন কর-মূসক এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ নির্ধারণ করা আছে। চার স্তরবিশিষ্ট সিগারেটে প্রিমিয়াম, উচ্চ ও মধ্যম স্তরে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ হলেও সবচেয়ে বেশি বিক্রিত নি¤œস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক ৫৭ শতাংশ। ১৫ শতাংশ মূসক ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ সবগুলো স্তরেই রয়েছে। রাজস্ব বাড়াতে হলে সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হবে। সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কর বা স্পেসিফিক ডিউটি আরোপ করা যেতে পারে। তবে অনেকেই সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ বা বাড়ানোর দাবি করছে এনবিআরের কাছে। যা খানিকটা বিভ্রান্তির জš§ দিতে পরে। কারণ স্পেসিফিক সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক বলে কোনো কর আরোপের বিধান বা অস্ত্র নেই। হয় এসডি না হয় স্পেসিফিক ডিউটি। অথবা বিদ্যামান করভারের ওপর প্যাকেট প্রতি ৫ টাকা বা ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপের প্রস্তাব হতে পারে। কারণ এনবিআর আইন ও বিধিবিধানের বাইরে এক চুলও এদিক ওদিক হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলোর কর প্রস্তাবেও আইন ও বিধিবিধানের বাইরে কোনো কিছু প্রস্তাব দিতে পারে না। যদি দেয়া হয় তাহলে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পথ সুগম হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয় জনস্বার্থে ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায়।
সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য-এমআরপি নির্ধারণের বিষয়টি বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবিও নিশ্চিতভাবেই অবহিত এবং তারা এনবিআরের এ নিয়ম কাঠামো মেনেই স্তরভিত্তিক সিগারেটের মূল্য নির্ধারণী প্রক্রিয়া মেনে চলছে। কিন্তু বাজারে তারা সিগারেটের ভোক্তা-ক্রেতাদের ক্রয়মূল্য তথা সিগারেটের প্যাকেটে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নিয়ে খুচরা বিক্রেতার ক্রয় মূল্য হিসেবে দেখিয়ে দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মুনাফায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। কারণ ট্রেড মার্জিন অর্থাৎ এজেন্ট, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার কমিশনের টাকা না দেয়ায় পুরো টাকাটাই কোম্পানির পকেটে থেকে যাচ্ছে। তাইতো এনবিআর বলছে, ‘সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কারখানা অঙ্গন থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের ওপর প্রযোজ্য কর পরিশোধ করে সিগারেট সরবরাহ করায় বিদ্যমান মূসক আইন অনুযায়ী উৎপাদনকারী পর্যায়ে রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। কিন্তু, খোলাবাজারে প্রতি শলাকা সিগারেট বেশি মূল্যে বিক্রয় হওয়ার কারণে একদিকে ভোক্তা অবৈধ মূল্যবৃদ্ধির চাপের সম্মুখীন হচ্ছে অপরদিকে খুচরা বিক্রয় পর্যায়ে ওই অতিরিক্ত মূল্যের ওপর প্রযোজ্য রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে।’ আর জনগণের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য আদায়ের কৌশলের কারণেই হু হু করে মুনাফা বাড়ছে সিগারেট কোম্পানির মুনাফা। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বিএটিবি কর পরবর্তী নিট মুনাফা করেছ ১৭৫৭ কোটি টাকা!
আর কোম্পানি কমিশন না দেয়ায় গায়ের রেটে সিগারেট কিনতে হচ্ছে খুচরা দোকানিদের। ফলে তারা খুচরা শলাকা ও প্যাকেট বিক্রির জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি নিচ্ছে। এমনকি বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রির জন্য রীতিমতো বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে রাখে টি স্টলসহ দোকানগুলোতে। জাপান টোব্যাকো তাদের ক্যামেল সিগারেটের প্রতি শলাকা ৮ টাকা করে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে আছে শহর থেকে গ্রামের দোকানগুলোতে। সেই হিসাবে ২০ শলাকার এক প্যাকেট ক্যামেল সিগারেটের দাম হয় ১৬০ টাকা। কিন্তু এনবিআর কর্তৃক ক্যামেল সিগারেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৩০ টাকা, যা প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত আছে। তাহলে জেটিআই’র বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০ শলাকার প্রতি প্যাকেটে বাড়তি নিচ্ছে ৩০ টাকা, শতাংশের বিবেচনায় ২৩ শতাংশ বেশি টাকা আদায় করছে! যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ওই বৈঠকেই, বলা হয়েছে, ‘ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইনগত অভিমত হলো Bangladesh Standards and Testing Institution(BSTI)-এর পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা, ২০২১ এর বিধি ৫ এর উপ-বিধি(৬) অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্যের মোড়কের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য’ মুদ্রিত থাকতে হবে এবং সেটিই হচ্ছে ভোক্তা মূল্য যা সিগারেট কোম্পানিগুলো মানছে না।’ অথচ বিএটি ও জেটিআই দুটিই বহুজাতিক কোম্পানি, যারা নিয়ম-কানুন মেনে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা করার তথাকথিত করপোরেট সুশাসনের ছবক দিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। মূল্য সংযোজন করÑমূসক আইন, মোড়কজাত বিধিমালাসহ দেশের আইনকানুন লঙ্ঘন করা কি করপোরেট সুশাসনের নমুনা?
মিথ ৩ : বাজেটের আগেই কৃত্রিম সংকটে দাম বাড়ানোর কৌশল
বছরেজুড়ে এমআরপি আইন ও বিধি ভঙ্গ করেই বছরজুড়ে সিগারেট প্রতি গড়ে ১ টাকা করে বাড়তি মূল্যই নিয়েই ক্ষান্ত হয় না সিগারেট কোম্পানিগুলো। লাভের ওপর লাভ করতে তারা প্রতি বছর বাজেটের আগেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। জনগণের পকেট কাটার অবৈধ ব্যবসার ব্যতিক্রম হয়নি, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়েছে সরবরাহ সংকট তৈরি খেলা।
প্রতি বছর জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে জাতীয় বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। দীর্ঘ এক মাস আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে কিছু কাটছাঁট করে বাজেটে পাস হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো পণ্যে আমদানিসহ শুল্ক কমানো বা বাড়ানো হলে তা বাজেটে উপস্থাপনের দিন থেকেই কার্যকর হয়। যাতে শুল্ক বৃদ্ধি বা কমানোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে কেউ পণ্য মজুত করতে না পারে। সিগারেট কোম্পানিগুলো কিন্তু এ আইন খুব ভালো করেই জানে। তারপরও দেখা যায়, প্রতি বছরই মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাড়তি দামে কিছু কিছু ব্রান্ডের সিগারেট বিক্রি হতে দেখা যায় খুচরা দোকানগুলোতে। দোকানিদের ভাষ্য, সিগারেট কোম্পানির এজেন্টরা সিগারেট সরবহার কমিয়ে দিয়েছে বলেই তাদের বাড়তি দামে সিগারেট কিনতে হচ্ছে। প্রতি বছর কেন বাজেটের আগে বাজারে কৃত্রিম সংকট হয় সেই প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ নিশ্চয় এ মাসে ভোক্তারা বাড়তি সিগারেট খায় বলে সিগারেটের সরবরাহে সংকট দেখা দেয়? না, তা নয়, সিগারেটে কোম্পানিগুলোর ডিলার এজেন্টরাই কৌশলে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি মানুফার জন্য। এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না সিগারেট কোম্পানি। কারণ এটা আর পাঁচটা পণ্যের মতোন নয়। এটার সরবরাহ চেইন পুরোটা নিয়ন্ত্রণ হয় নিজ নিজ সিগারেট কোম্পানির দ্বারা। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতি বছরের মতো এবারও মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে কী বাড়তি মুনাফার কারসাজির জন্যই কি তাহলে সিগারেটের প্যাকেটে গায়ে উৎপাদনের তারিখ লেখে না তারা? মানুষের সেবন বা ভক্ষণ বা ব্যবহƒত পণ্য উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ প্যাকেট বা বোতলের গায়ে উল্লেখ থাকা বাধ্যতামূলক। প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনের তারিখ মুদ্রিত থাকলেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার সহজে ধরা পড়ত। একইভাবে বাজেটের প্রস্তাব পরেও পুরোনো দামের সিগারেট নতুন দামে বিক্রির মাধ্যমে মাসে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় জনগণের কাছ থেকে, যা পুরোপুরি অবৈধ। নতুন দামে বিক্রি করতে হলে পুরোনো দামের প্যাকেটে নতুন দামের সিল যুক্ত করে বিক্রি করার বিধান রয়েছে এনবিআরের, যা বছরের পর বছর ধরে জুন, জুলাই, আগস্ট, এমনকি সেপ্টেম্বর মাস পযর্ন্ত পুরোনো দামের প্যাকেট নতুন দামে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সিগারেট কোম্পানিগুলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং করণীয়:
এক. সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য এমআরপি মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত করা; দুই. নি¤œস্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ওপরের তিনটি স্তরের মতোই ৫৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং তিন. সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যে উৎপাদনের তারিখ উল্লেখ করা।
এক দিকে এমআরপি আইন লঙ্ঘন করে সিগারেট কোম্পানির বৈধভাবে অবৈধ ব্যবসায় বন্ধ করার উদ্যোগ। অন্যদিকে সিগারেটের চার স্তরেই করভার সমান করা হলে সরকারের বছরে বাড়তি রাজস্ব আসবে ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয় বাড়লে হƒদরোগের চিকিৎসাসহ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় খরচ করার সক্ষমতা বাড়বে সরকারের। অন্যদিকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আশা করি, যা এবারের বাজেটে প্রতিফলন ঘটবে।
সাংবাদিক
sinhasmp@yahoo.ocm