ড. মো. রিজওয়ানুল ইসলাম: সম্প্রতি দেশের কর্তাব্যক্তিরা রেলওয়ে টিকিট কেনার মতো একটি অতি সাধারণ সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রেও জাতীয় পরিচয়পত্রের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য হলো, রেলওয়ে টিকিটের কালোবাজারি বন্ধ করা। কিন্তু কীভাবে এই ব্যবহারের মাধ্যমে কালোবাজারি বন্ধ হবে তা বোঝা দুরূহ। হাজার হলেও টিকিট কালোবাজারিরা বিদেশি নয় এবং তাদের নিজেদের ও আত্মীয়-পরিজনের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তারা কালোবাজারি করতেই পারে। প্রকৃতপক্ষে টিকিট কালোবাজারি করা রেলওয়ে টিকিটের কৃত্রিম সংকটের একটি কারণ হতে পারে; কিন্তু ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত টিকিটের ব্যবস্থা রাখার মতো অন্যান্য বিষয়ও ট্রেনের টিকিটকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। যখন ট্রেনের টিকিটের উচ্চ চাহিদা থাকে বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বার্থের মতো উচ্চ চাহিদার টিকিটের ক্ষেত্রে ভিআইপি টিকিটের বাড়াবাড়ি সমাচার কম-বেশি সবারই জানা।
সরকারি বিভিন্ন কাজকর্ম বা সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, এটাকে একধরনের বাড়াবাড়ি বলাটা অতিরঞ্জিত হবে না। ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতে লেনদেন বা পাসপোর্টের মতো বিষয়ের সঙ্গে সন্ত্রাসী অর্থায়ন বা অন্যান্য গুরুতর বিষয় জড়িত থাকায় বাধ্যতামূলক জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার যুক্তিসংগত। কিন্তু এত বেশি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে যে, এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে কোন কোন সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয় না। জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করতেই হবে এমন বিষয়ের সংখ্যা এমনভাবে বাড়ছে যে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন চেইনশপের লয়্যালটি কার্ডের সেবার জন্যও জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হবে!
আমাদের হয়তো পেছনে ফিরে তাকানোর সময় হয়েছে এবং যদি আমরা তা করি, তবে দেখব এ দেশে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রচলন হয়েছিল জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটার শনাক্তকরণের জন্য। তারপর স্বাভাবিকভাবেই নকল পরিচয় ব্যবহার করে সন্ত্রাসী ও অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করাটা কাম্য। বড়জোর এটাকে হয়তো বিভিন্ন বিমানবন্দরে মানুষকে যে স্ক্যানিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে ধরনের একটি যন্ত্রণাদায়ক কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে মেনে নিতে পারি। অবশ্য এ ধরনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া আমরা জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার যত বাড়াব, যত বেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত হব, ততই এর অপব্যবহারের আশঙ্কা বাড়বে এবং নাগরিকের ভুক্তভোগী হওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে।
সমাজতাত্ত্বিকরাই ভালো বলতে পারবেন; তবুও এটা বলছি যে, আমাদের বাধ্যতামূলক জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহারের আসক্তির সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও বাড়তি কাগজের প্রতি অনুরাগের একটি সংযোগ আছে। খুব কম সময়ই আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা অল্প কাগজে তুষ্ট হন। এটা মনে হয়, যত বেশিসংখ্যক কাগজ কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হয়, কর্তৃপক্ষও ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। মানুষের জমা দেওয়া কাগজের স্তূপ যেসব কর্তৃপক্ষকে জমা দেওয়া হয়, তাদের একটি স্বস্তির অনুভূতি হবে যে, তারা অনেক কাজে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে কাজের দীর্ঘসূত্রতার একটি অজুহাতও সৃষ্টি করবে। এমনকি সাধারণ মানুষকেও যদি একগাদা কাগজ জমা দিতে হয়, এতে কখনও কখনও তেমন কোনো অসন্তোষ না থাকার কারণ হতে পারে আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহ্য। এটা তো জানাই যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ঔপনিবেশিক প্রভু ও তাদের সেবকদের আমলাতান্ত্রিকতার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হতো।
বিশ্বের অনেক দেশেই আমাদের দেশের মতো সব বিষয়েই জাতীয় পরিচয়পত্রের যত্রতত্র ব্যবহার হয় না। এমনকি অনেক দেশে একটি প্রি-পেইড মোবাইল সিমকার্ড (যার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত বলে মনে করা হয়) কিনতে কোনো পরিচয়পত্রেরই প্রয়োজন হয় না। এর অর্থ এ নয় যে, আমাদেরও তা অনুসরণ করতে হবে; কিন্তু এ থেকে বোধ হয় বলাই যায় বিশ্বের অনেক দেশের প্রশাসনই ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংবলিত কাগজপত্রের অপব্যবহারের আশঙ্কা সম্বন্ধে সচেতন।
এটি অত্যন্ত হতাশাজনক যে, আমাদের দেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের অতিরঞ্জন, যেমন একটি কার্ড দিয়ে ১০০০-এর বেশি মোবাইল নিবন্ধনের (যদিও তখন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ প্রয়োজন হতো না) মতো ঘটনাও আমাদের নীতিনির্ধারকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের অপব্যবহারের মারাত্মক ঝুঁকির ব্যাপারে তেমন সংবেদনশীল করেনি। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এটা মনে রাখা উচিত যে, জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংবলিত কাগজ যত বেশি ব্যবহার হবে, এ নিয়ে ঝুঁকিও তত বাড়বে। জীবনের অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও বোধহয় এমন একটি বিষয়।
সহযোগী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইংরেজি থেকে অনূদিত: শেখ নোমান পারভেজ