জানার জন্য পড়তে হবে

অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষকে তাড়িত করে। আর জ্ঞান অর্জন তথা জানার অন্যতম মাধ্যম হলো বই পড়া। এ ছাড়া জানার অনেক মাধ্যম রয়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই বই পড়ে নতুন নতুন জিনিস শিখেছি। বইয়ের ভেতর আঁকা ছবি দেখে কল্পনার জগতে সাঁতরেছি। একটা বই পেলে, না পড়লেও অন্তত বইতে থাকা ছবিগুলো পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখতাম। এর মাধ্যমে অনেক কিছু শেখা হতো। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা বলতেন, বন্ধুত্ব করলে বইয়ের সঙ্গে করো, অন্য সবাই ফাঁকি দিলেও বই ফাঁকি দেয় না। এসব কথা বলে তারা আমাদের বইয়ের দিকেই আকর্ষিত করতেন। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। বই আসলেই নিঃস্বার্থ বন্ধু। এটি আমাদের কাছ থেকে কিছু নেয়া না, কিন্তু দেয় পাহাড়সম। বই আমাদের বাঁচতে শেখায়। পুরোনো ইতিহাস অবগত করে, একজন পাঠককে চৌকস করে তোলে। শেখায় কীভাবে ভালো আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যের মন জয় করতে হয়। শত দুরাশার মধ্যেও কীভাবে আশার বীজ বুনতে হয় বই আমাদের তা অনুধাবন করতে শেখায়।

প্রযুক্তির জয়যাত্রার এ সময়ে মানুষের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। বই এখন ছাপা কাগজের মলাট থেকে বেরিয়ে মোবাইলে জায়গা করে নিয়েছে। সহজ হয়েছে জানার মাধ্যমও। এখন মনে কোনো প্রশ্ন জাগলেই আমরা মুহূর্তেই তা গুগলে চার্জ দিয়ে জানতে পারি। ধরুন, আপনি রান্নাবিষয়ক কিছু জানতে চাইছেন। এজন্য আপনাকে ভালো কোনো রাঁধুনির শরণাপন্ন হওয়ার দরকার নেই। গুগলে চার্জ দিয়ে সহজেই পেয়ে যাবেন এ সম্পর্কিত নানা তথ্য। এখন বাইরে বেড়াতে গেলেও বই বহন করা লাগছে না। হাতে একখানা স্মার্টফোন থাকলেই যেকোনো জায়গায় বসে, যে কোনো সময় বই পড়া যায়। করোনাকালীন এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে হয়েছিল। এ সময় অনেকেই বাড়িতে তেমন বইপত্র নিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু ইন্টারনেট থেকে আমরা আমাদের পছন্দের বই ডাউনলোড করে পড়তে পেরেছি। প্রযুক্তি যে আমাদের পড়াশোনা আরও সহজ করে দিয়েছে এটি তারই নমুনা মাত্র।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে যেমন কিছু বাজে গ্রুপ আছে অন্যদিকে আছে অনেক ভালো গ্রুপও। অনেক বইপ্রেমী সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তৈরি করেছেন নতুন নতুন শেখার অনেক সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম। করোনাকালে যখন শিক্ষার্থীরা অলস সময় পার করছিল, তখন অনেক সুহƒদ এগিয়ে এসেছিলেন কীভাবে এসব মাধ্যমগুলোতেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সক্রিয় রাখা যায়। তাই তো ফেসবুকে ঢুঁ মারলেই বুক রিভিউ, আঁকা ছবি, সাহিত্য আড্ডা, সৃজনশীল সব ফেসবুক লাইভ চোখে পড়ত। এসব বিষয় আমাদের যে বার্তা দেয় তা হলো, প্রযুক্তি আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে প্রযুক্তির এ আশীর্বাদ যেন কল্যাণের জন্য ব্যবহƒত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

কভিড যখন বাড়ি ছিলাম, তখন কাগজের পত্রিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কেননা প্রত্যন্ত অঞ্চলে খবরের কাগজ পাওয়া দুষ্কর। ছাপা পত্রিকা না পড়তে পারায় একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু ই-পেপার সে খারাপ লাগাটা দূর করে দিল। কাক্সিক্ষত পত্রিকার নামের আগে ‘ই’ লিখে গুগলে চার্জ দিলেই ছাপা পত্রিকা হুবাহু চলে আসছে। এখন চাইলেই অজপাড়াগাঁয়ে বসেও পৃথিবীর নামিদামি পত্রিকা কিংবা বই সহজেই পড়া সম্ভব।

প্রযুক্তি যত বিকশিত হচ্ছে আমাদের জানার বা শেখার মাধ্যমও তত সহজ হচ্ছে। আগে একজন শিক্ষার্থীকে একটি বাংলা বা ইংরেজি শব্দ খোঁজার জন্য অনেক সময় নিয়ে অভিধান ঘাটতে হতো। এখন স্মার্টফোনে রয়েছে বিভিন্ন ভাষার অভিধানের অ্যাপ। যেখানে চার্জ দিলেই মুহূর্তেই কাক্সিক্ষত শব্দটির অর্থ চলে আসছে। সবকিছু হাতের নাগালে থাকলেও তরুণদের মধ্যে নতুন নতুন শেখার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

দুঃখের বিষয় হলো, কিশোর-তরুণদের মধ্যে বই পাঠে অনীহা লক্ষণীয়। দেখা যায়, অনেকেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় টিকটিক, ভিডিও গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চ্যাটিং কিংবা ইউটিউবে অপ্রয়োজনীয় ভিডিও দেখে নষ্ট করছে। কেউ কেউ আবার ফেসবুকে একে অন্যের প্রতি বাজে মন্তব্য করতে সরব হয়; যা কখনও কাম্য নয়। বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবনে এসেছে গতিশীলতা। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে আমাদের সামনে আসছে নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জ; যা মোকাবিলায় তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। তাই আমাদের উচিত প্রযুক্তিকে কাজ লাগিয়ে নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা।

আগেরকার সময়ে দেখা যেত, সন্ধ্যা হলেই মায়েরা কুপি বাতি জালিয়ে সন্তানদের নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে যেতেন। কিন্তু সেসব দৃশ্য আজ বিরল। অনেক মা-বাবার সময় মোবাইলের স্ক্রিনে বন্দি। আবার অনেকে অফিসের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে আর সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। প্রাইভেট পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের কোচিংয়ে পাঠিয়ে তারা চিন্তা মুক্ত হতে চান। কিন্তু সেখানে যা পড়ানো হয় তা অনেকটা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। কোচিংগুলো মোটামুটি পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে জ্ঞানের বিশাল শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তার সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় না। পরীক্ষার জন্য যতটুকু পড়া দরকার তার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন তারা। ফলে তৈরি হচ্ছে বইবিমুখ প্রজন্ম। পরীক্ষায় পাস করাটাই শেষ কথা নয়, শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে হবে জীবনের শেষ অব্দি।

আশাজাগানিয়া দিক হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে পাঠাগার। তরুণরা হচ্ছে অধিকাংশ পাঠাগারের কর্ণধার; যা আমাদের আশাবাদী করে। আবার অনেক সুহƒদ নিজ থেকে অন্যের কাছে বই পৌঁছে দিচ্ছে। সেলুনে আসা প্রতিটি মানুষের সময় যাতে কাজে লাগে তার জন্য অনেক হƒদয়বান তৈরি করছেন সেলুন পাঠাগার। কেউ কেউ ফেসবুক গ্রুপ বা পেজের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিচ্ছেন। পরিবারের জ্ঞানের পিপাসা নিবারণের জন্য অনেকে গড়ে তুলছেন পারিবারিক লাইব্রেরি।

দিন দিন মানুষ অনলাইনমুখী হলেও কাগজে বাঁধানো বইয়ের আবেদন কখনও কমার নয়। অনেক পাঠক আছেন মোবাইলে একটানা পড়তে পারেন না। কিন্তু কাগজে বাঁধানো বই পড়তে পছন্দ করেন না এমন পাঠক পাওয়া দায়। মোবাইলের স্ক্রিনে একটানা চোখ রাখাও স্বাস্থ্যের পক্ষে সুখকর নয়। অনেক সময় দেখা যায়, মোবাইলে বই পড়ার সময় হঠাৎ কল চলে আসে কিংবা ডেটা অন থাকলে নোটিফিকেশন চলে আসায় পড়ার মনোযোগ নষ্ট হয়। ধরুন একজন শিক্ষার্থী কোনো একটি বিষয়ে ইউটিউবে ক্লাস খুঁজতে গেল কিন্তু সামনে চলে এলো তার পছন্দের কোনো নাটক, ছবি বা গান। তখন কিন্তু আর তার ওই ক্লাসটি ঠিকমতো করা হয়ে উঠে না। এতে সময়ের ও অপচয় হয়। এক্ষেত্রে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

সামনের দিনগুলোতে তরুণদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে তাদের। তার জন্য নতুন নতুন জানার বা শেখার বিকল্প নেই। আর এ জানার জন্যই পড়তে হবে।

মারুফ হোসেন

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০