মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার একাংশসহ ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আড়িয়ল বিলের অবস্থান। এখানে বর্তমানে এক লাখ ৬৭ হাজার একর জমি রয়েছে। এ জমির ওপর নির্ভর করে চলে স্থানীয় অনেকের জীবন ও জীবিকা।
ভৌগোলিকভাবে পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির মাঝখানে বিলটির অবস্থান। এক সময় এ বিলের নাম ছিল চুড়াইন বিল। জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ নামে ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখানদী প্রাচীন বিক্রমপুরের ওপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত হতো। সে সময় প্রাচীন বিক্রমপুরের অংশ দিয়ে বর্তমানে মাদারীপুরে এখনও আড়িয়াল খাঁ নদীর অস্তিত্ব ইতিহাসের সাক্ষী দিচ্ছে। এক সময় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হলে নদীর এ অংশটুকু মৃত নদীতে রূপান্তরিত হয়। পরে এটি বিলের রূপ ধারণ করে। পূর্ব নাম চুড়াইন বিল বদলে আড়িয়াল খাঁ নদীর নামানুসারে এ বিলের নাম ‘আড়িয়ল বিল’ নামকরণ করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
আড়িয়ল বিলের বর্তমান সীমানা হচ্ছে শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণে দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, প্রাণিমণ্ডল, গাদিঘাট, রাড়িখাল ও মাইজপাড়া। উত্তরে শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, শেখরনগর, মদনখালী, সুতারপাড়া, আলমপুর ও তেঘরিয়া। পূর্বে হাঁসাড়া, ষোলঘর, কেয়টখালী, লস্করপুর ও মোহনগঞ্জ। আর পশ্চিমে কামারগাঁও, বালাসুর, জয়পাড়া, জগন্নাথ পট্টি, কাঁঠালবাড়ী ও মহুতপাড়া গ্রামগুলো অবস্থিত।
বিলে ছোট-বড় মিলে প্রায় হাজারখানেক জলাধার, ডোবা ও পুকুর থাকলেও বড় ডাঙাগুলো পূর্বে স্থানীয় জমিদার বা রাজারা খনন করেছিলেন। বিলের দক্ষিণ প্রান্তের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিঘি হচ্ছে নৈমুদ্দিন, সানাইবান্ধা, বাগমারা, সাগরদিঘি, বৈরাগীরডাঙা, খালেকসাবডাঙা, মনসা, কালাচান দিঘি, বসুমালা, কলাগাছিয়া, নারকেলগাছিয়া, তালগাছিয়া, ঝরঝরিয়া, পরশুরাম, আঠারোপাখি, সাচরাতি, সেলামতি প্রভৃতি।
ভরা মৌসুমে এ বিলে প্রচুর দেশি মাছ ধরে হাজারো পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। পরে বিলে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। এরপর থেকেই আড়িয়ল বিলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ হতে থাকে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতকালে অপেক্ষাকৃত উপরাংশে রবিশস্য ও মাটি কেটে ভিটিতে করলা, খিরা, টমেটো, কুমড়া, লাউ প্রভৃতি শাকসবজির আবাদ শুরু করেন কৃষকরা।
আড়িয়ল বিলে এক সময় অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পাখির আনাগোনা ছিল। বুনোহাঁসগুলো সকালে পদ্মার চরে আশ্রয়ে থাকত। পরে সন্ধ্যা হলেই দল বেঁধে আবার বিলে ফিরে আসত। বিলের চারপাশে মাছ এবং সবজির দৈনিক ও সাপ্তাহিক হাট বসত। নিকটবর্তী মাইজপাড়া সংলগ্ন ‘অদেরপাড়ের হাট’ থেকে গ্রামের লোকজন বর্ষাকালীন ছয় মাসের কুমড়া কিনে এনে ঘরের চৌকির নিচে রেখে দিত।
অতীতে আড়িয়ল বিলে ২০-২৫ হাত পানি হতো। বিশাল বিশাল ঢেউ উত্তর দিকে আছড়ে পড়ত। গরুর খাবারের জন্য অনেকেই ‘মনকা’ নামে দল-জাতীয় ঘাস বড় নৌকায় করে বিল হতে তুলে নিয়ে বাড়ির পাশে পানিতে রেখে মজিয়ে গরুকে খাওয়াতেন। বিলের ঢেউয়ের কারণে উত্তরের জনপদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উঁচু বাড়ির মাটি ঢেউয়ের আঘাতে পাড় ভেঙে পড়ত। আমন ধান ঢেউয়ের তোড়ে অথবা কচুরিপানায় নষ্ট হয়ে যেত। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ফসল ও ঘরবাড়ি রক্ষার আবেদন জানালে সরকার আলমপুর হতে পশ্চিমে প্রায় আট কিলোমিটার গজারি গাছের খুঁটি পুঁতে কয়েক স্তর মোটা তার লাগিয়ে দেয়। ফলে বেড়ার দক্ষিণ পাশে জমে থাকা কচুরির স্তূপের কারণে ঢেউ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হলে উত্তরের জনপদে স্বস্তি নেমে আসে। রাড়িখাল সংলগ্ন বিলে গেলে উত্তর দিকে তাকালে সারি সারি খুঁটির রেখা দেখা যেত।
৮০’র দশকের মাঝামাঝি হতে খুঁটিগুলো আর দেখা যায়নি। এগুলো নানা কায়দায় বেহাত হয়ে গেছে। বিলের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ব্যর্থ ঝগই বাঁধ ও কজই বাঁধের কারণে পদ্মার জোয়ারের পানি ঢোকার সবগুলো প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে আছে।
এমনকি শ্রীনগর-ভাগ্যকূল সড়কের আগের সাতটি কাঠের ও একটি লোহার পুল তুলে ফেলে সে স্থানগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। এ বিলে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণের কথা ছিল। এলাকার কিছু লোক ও পরিবেশবাদীরা আড়িয়ল বিল রক্ষায় আন্দোলনে নামেন। সরকারও সে সময় এখান থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু ভূমি দখলদারদের আগ্রাসন মোটেও থেমে নেই। দিন দিন নতুন নতুন বসতির লোকালয়, ইটভাটা, ইট তৈরির জন্য বিলের টপসয়েল কেটে নেওয়া প্রভৃতি বাধাহীনভাবেই চলছে।
পানির অভাবে ডাঙাগুলোয় এখন প্রাকৃতিক মাছ সেভাবে পাওয়া যায় না; তাই বাধ্য হয়ে জেলেরা কৃত্রিম পোনা ছাড়ছেন। এভাবে চলতে থাকলে আড়িয়ল বিল কয়েক বছরে তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে।
বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলঘেঁষা গাদিঘাট গ্রামের নুর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের স্কুলজীবনে এখানের যাতায়াতব্যবস্থা ভালো ছিল না। বাঁশের সাঁকো, পানি-কাদা মাড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হতো। শিক্ষকদের দেখেছি ঢোলা পায়জামা পরে ক্লাসে আসতেন। রাস্তায় পানি-কাদা থাকায় পায়জামা ঢোলা হলে হাঁটুর ওপড় টেনে ওঠাতে সহজ হয়। ৭৯ সালে আমাদের বাড়ির পাশে শ্রীনগর-ভাগ্যকূল রোডে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি লাগানো হয়। ৮১ সালে গাদিঘাট আলোয় আলোকিত হয়। দক্ষিণ রাড়িখাল বালাসুর প্রান্তে গেলে রাতের বেলা গাদিঘাটে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতাম। যদিও গাদিঘাট গ্রামটি বর্ষাকালে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠত। কারণ ভরা বর্ষায় ওখানে ২০ থেকে ২৫ হাত পানি হতো, ঢেউয়ের তোড়ে এমনিতেই তখন আমন ধান হতো না, বাড়িঘর রক্ষায় চারদিক কচুরিপানা চাপিয়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে রাখা হতো। তারপরও মাঝে মাঝে অতিরিক্ত প্লাবন ও ঝড়ে গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
গাদিঘাট অতীতে কুমড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনও কুমড়ার আবাদ হয়। পাশাপাশি লাউ, করলাসহ অন্যান্য সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। বাজারে খুব ভোরে এবং বিকালে মাছ ও সবজি ওঠে। চাহিদা থাকায় দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। কারণ বিলের মাছ এখনও সুস্বাদু। নানা কারণে আড়িয়ল বিল এখন পরিচিতি পেয়ে গেছে। বহু লোক আড়িয়ল বিল দেখতে চান; কিন্তু পাকা ব্রিজ পর্যন্তই যাওয়া যায়। ব্রিজের কাছে পিকনিক স্পটসহ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বানালে ভালো বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে।
আগের দিনে শীতের এ সময়টায় আড়িয়ল বিলে ঢুকলে ভিটায় বসে যত খুশি ফ্রি কচি খিরাই ও লাল টুকটুকে টমেটো খাওয়া যেত। কিন্তু বহন করে নিয়ে আসায় নিষেধাজ্ঞা থাকত। আড়িয়ল বিলে কৃষকরা যার যার ক্ষেতের মাটি কেটে দুই থেকে তিন হাত উঁচু ভিটা বানাতেন। সে ভিটায় তারা খিরা, টমেটো, লাউ চাষ করতেন। সবকিছুই স্বাস্থ্যসম্মত ছিল। এখন বিলে অল্প পরিমাণে এগুলোর চাষ হয়।
সম্প্রতি লগ্নিকারক পাইকাররা ছাউনি করে পাহারা বসিয়েছেন। এখন আর কেউ বিনামূল্যে খেতে পারেন না। শীতের এ সবজি ওঠার পর নতুন করে কুমড়ার আবাদ হয়, প্রচুর কুমড়া পাইকারদের হাত ঘুরে ঢাকা বা অন্যান্য জেলায় বিক্রির জন্য চলে যায়।
আড়িয়ল বিলে রয়েছে কালেম পাখি। স্থানভেদে এটি কালিম, কায়িম, কায়েম প্রভৃতি নামে পরিচিত। আড়িয়ল বিলের বড় বড় ডাঙার ঘন কচুরিতে এদের বসবাস ছিল। শীতকালে সকালে রোদ পোহানোর জন্য তারা বেরিয়ে আসত। মানুষের সাড়া পেলে কচুরির ভেতর ঢুকে পড়ত। এরা জনমানবহীন এলাকায় কীটপতঙ্গ খাওয়ার জন্য দল বেঁধে হেঁটে বেড়াত।
শেখ মোহাম্মদ রতন