রোহান রাজিব: ব্যাংকবহির্ভূত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার এক যুগ পূর্ণ করল মোবাইল ব্যাংকিং। ২০১১ সালে চালু হওয়া এ সেবা বাংলাদেশের আর্থিক সেবায় বড় বিপ্লব এনেছে। এক যুগে লেনদেন ও গ্রাহকের সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এমএফএস সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭ জনে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা এক লাখ ৫৯৩ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। এ অঙ্ক মোবাইলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড লেনদেন। ওই মাসে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ এক লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ১১২ জনে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকের সেবা নিতে বিকল্প চ্যানেলও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে দেশে। এর অন্যতম মাধ্যম হলো মোবাইল ব্যাংকিং। বাংলাদেশে আর্থিক সেবায় বড় বিপ্লব এনেছে এ সেবা। ফলে বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়ের মতো ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গ্রাহকরা সহজে হিসাব খুলতে পারছেন। আর টাকা স্থানান্তর করা যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এমএফএসের আওতায় রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও। এখন সঞ্চয়ের পাশাপাশি ঋণও মিলছে এ সেবায়। বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, মোবাইল ফোনের রিচার্জ এবং টাকা পাঠানোসহ নানা লেনদেনও করা যাচ্ছে ঘরে বসে। গ্রাহকরা ঘরে বসেই ডিজিটাল কেওয়াইসি (গ্রাহক সম্পর্কিত তথ্য) ফরম পূরণ করে হিসাব খুলতে পারছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে মোট লেনদেনের মধ্যে টাকা জমা হয়েছিল ৩১ হাজার ২৬০ কোটি ও উত্তোলিত হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৮৮ কোটি। ফলে মোট লেনদেনের প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল জমা ও উত্তোলন। বাকি ৪০ শতাংশ লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে।
দেশে এমএফএস সেবার বড় অংশ দখল করে আছে ‘বিকাশ’। সেবার পরিধিও তাদের সবচেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম শেয়ার বিজকে বলেন, এখন মোবাইল আর্থিক সেবার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। এর সঙ্গে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, সৃজনশীল ও সময়োপযোগী নানা সেবা-পরিষেবা যুক্ত হচ্ছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সেবার বিল ও সুরক্ষা ভাতা, উপবৃত্তি ও প্রণোদনা বিতরণে এখন মোবাইল ফোনে পরিশোধ করছে। রেমিট্যান্স আসছে কর্মীদের বেতন-বোনাস দেয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ ক্যাশলেস লেনদেনে অভ্যস্ত হচ্ছেন। এসব কারণে এমএফএস সেবায় লেনদেনের সঙ্গে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা বাড়বে, সঙ্গে এ সেবার লেনদেনও বেড়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। এখন মোবাইল
ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে এমএফএস সেবায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসেবে ২৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ বিতরণ হয় দুই হাজার ৮৪৯ কোটি টাকার। বিভিন্ন পরিষেবার এক হাজার ৯৬১ কোটি টাকার বিল পরিশোধ হয় এবং কেনাকাটার তিন হাজার ৭৭২ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এক যুগে লেনদেনের যে রেকর্ড গড়েছে এটা অনেক বড় অর্জন। শুরুতে এ সেবা ক্যাশ ইন-ক্যাশ আউটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন অনেক সেবা যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল ফোন রিচার্জ ও অনুদান বিতরণের অন্যতম মাধ্যম এটি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজে টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। ফলে এ সেবা মানুষ সহজে গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাই আগামীতে এমএফএস সেবার মাধ্যমে লেনদেন আরও বাড়বে।