শেয়ার বিজ ডেস্ক: টয়োটা, মাজদা, সুজুকি, দাইহাটসু, হোন্ডা ও ইয়ামাহাÑজাপানের এই খ্যাতনামা গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে পরীক্ষার সনদ দিয়েছে। একে ২০১৫ সালের জার্মানির গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভোকসওয়াগনের কার্বন নিঃসরণ নিয়ে মিথ্যা প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করেছে ডয়চে ভেলে।
গত সপ্তাহে জাপানি টেলিভিশনগুলোয় দেখা যায়, দেশটির কিছু কর্মী উদ্বিগ্ন হয়ে সুজুকি মোটর করপোরেশনের সদর দপ্তরে ছুটে আসছেন। কারণ কয়েক দিন আগেই সুজুকিসহ পাঁচটি জাপানি গাড়িনির্মাতা কোম্পানি গাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষার সময় মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে। এর পর থেকে দেশটির সর্বস্তরে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জাপানের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা স্বীকার করেছেন, ঘটনাটি শুধু জাপানের অটোমোবাইল সার্টিফিকেশন সিস্টেমের ভিতকেই নাড়িয়ে দেয়নি, বরং জাপানের অটোমোবাইল শিল্পের বিশ্বাসযোগ্যতারও ক্ষতি করেছে। কিছু বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন, অটোমোবাইল শিল্প জাপানের উৎপাদন শিল্পের একটি স্তম্ভ। তাই এ ধরনের জালিয়াতির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
গত বছরের এপ্রিলে একটি ‘রহস্যময়’ চিঠিতে দাইহাটসু মোটর করপোরেশনের এক কর্মী জাপানের পরিবহন বিভাগকে তার কোম্পানির মিথ্যা তথ্য বানানোর প্রমাণ দাখিল করেন। একই বছরের ডিসেম্বরে জাপান সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দাইহাটসু মোটর করপোরেশনের মিথ্যা তথ্য বানানোর ইতিহাস আশির দশকের শেষের দিকে শুরু হয়। ওই সময়টা ‘মেড ইন জাপানের’ স্বর্ণযুগ ছিল। অর্থাৎ দাইহাটসু ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মোটর জালিয়াতি করছে।
চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে জাপানের পরিবহন বিভাগের জরিপে দেখা যায়, দাইহাটসু মোটরের এ কাজটাকে বলা যায় ‘হিমশৈলের অগ্রভাগ’। টয়োটা মোটর করপোরেশন, হোন্ডা মোটর, মাজদা মোটর করপোরেশন, ইয়ামাহা মোটরস এবং সুজুকি মোটরসহ জাপানের পাঁচটি প্রধান গাড়ি প্রতিষ্ঠানের মোট ৩৮টি মডেলের গাড়ি এ নকল তথ্যের সঙ্গে জড়িত। এগুলোর ছয়টি মডেল এখনও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতারণা উšে§াচিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট জাপানি গাড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক ক্ষমা চেয়েছে।
তবে অনেক জাপানি মনে করেন, অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোয় প্রায়ই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং শুধু মাথা নত করে ক্ষমা চেয়ে বাজারের আস্থা পুনরুদ্ধার করা কঠিন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাপানি অটোমোবাইল শিল্পে মারাত্মক জালিয়াতি কেলেঙ্কারিগুলো উšে§াচিত হয়েছে এবং কারণগুলোও প্রায় একই রকম। গবেষণা ও উন্নয়নের সময় কমানো এবং স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ অনুসন্ধানের জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের ওপর অযৌক্তিক কিছু কাজ চাপিয়ে দেয়। সম্মুখ সারির (ফ্রন্ট লাইন) কর্মীরাও ঝুঁকি নিয়ে নকল তথ্য বানাতে বাধ্য হন। তাছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে জীবাশ্ম (ফসিল) জ্বালানির যানবাহনের ক্ষেত্রে জাপানি গাড়ি কোম্পানিগুলোর বাজার-সুবিধাটিও ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, জাপানি কোম্পানিগুলোর এই জালিয়াতি এবং নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো রাতারাতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়। বিগত কয়েক দশকে জাপানের উৎপাদন শিল্প উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও এর ফলে কিছু কোম্পানির সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা একটি স্থিতাবস্থাতেই সন্তুষ্ট। প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন ও সংস্কার করতে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই আত্মতুষ্টির মনোভাব কোম্পানিগুলোকে নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন বাজারের প্রতি সাড়া দিতে ধীরগতির বানিয়ে ফেলে। ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া জাপানি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং পরিদর্শন ও শাস্তির ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে।
জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের কারণে অনেক জাপানি কোম্পানির কিছু মডেলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে এবং গাড়ি কোম্পানি ও সাপ্লাই চেইন কোম্পানি উভয়ই বড় অর্থনৈতিক ক্ষতিতে পড়ছে। বর্তমানে জাপানের অটোশিল্পের উৎপাদনের পরিমাণ সামগ্রিক উৎপাদন শিল্পের প্রায় ২০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাপানের এ-জাতীয় শিল্প যদি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়, তবে এটি জাপানের মোট দেশজ উৎপাদনও (জিডিপি) কমিয়ে দিতে পারে।