জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কালোত্তীর্ণ। প্রয়াত হিরোহিতো জাপানের সম্রাট থাকাকালে একবার বলেছিলেন, যত দিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।
সম্রাট হিরোহিতো একজন বাঙালিকে লক্ষ করে এমন কথা বলেছিলেন এবং এটি ছিল একজন বাঙালির প্রতি জাপানের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। এই বাঙালির নাম রাধা বিনোদ পাল। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক ও আইনজীবী, যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও রাজশাহীতে। অবশ্য ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের নাগরিক হয়েছিলেন। জাপানের রাজধানী টোকিওর চিয়োদা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ। যাদের স্মৃতির সম্মানে এ সৌধ তৈরি, তারা জাপানের পক্ষে বা বিপক্ষে যুদ্ধে কিংবা কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন। তবে এখানকার একটি স্মৃতিস্তম্ভ ব্যতিক্রমী, যার স্মরণে এটি তৈরি, সেই রাধা বিনোদ পাল কোনো যুদ্ধ বা সহিংসতায় নিহত হননি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতের ১১ বিচারকের একজন ছিলেন রাধা বিনোদ পাল। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাধা বিনোদ পালের একটি প্রশ্ন ছিল বিচারে জাপানকে যেসব অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, অভিযোগকারী পক্ষ নিজেরাই সেসব অপরাধ সংঘটন করে আসছে দীর্ঘদিন। এ বাঙালি বিচারকের দৃঢ়তায়ই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণ দিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। নয়তো যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হতো জাপানকে।
জাপান বাঙালি বিচারকের নৈতিক অবস্থান চিরকাল মনে রাখবে। আমাদের বিশ্বস্ত বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে জাপান প্রথম দিকেই থাকবে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপান আমাদের কাছ থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বুধবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে জাপানের সহায়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
তারা বলেছেন, জাপানে দেশটিতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বেশকিছু সুবিধা পায়। তবে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব সুবিধা অব্যাহত থাকবে না। তখন দেশটির সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জাপানের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারকরণে প্রশাসনিক নানা জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
অতীত ও বর্তমানের নিরিখে জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূতও বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে জাপানেরও এ তেমন আপত্তি নেই। তবে এ ধরনের চুক্তি করার ক্ষেত্রে অনেক বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় জাপান এগিয়ে। এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে দেশটির সহায়তা বড় প্রয়োজন। এ বছর দেশটির সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ে কোনো ক্ষেত্রেই দেশটির সঙ্গে আমাদের মতদ্বৈধ হয়নি। আমাদের বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে জাপানের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা রয়েছে। পারস্পরিক সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে এ সম্পর্ককে ধরে রাখতে সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।