প্রতিনিধি, জাবি : ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার’ স্লোগানের জেরে মধ্যরাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের ৪ জন সহ অন্তত ৫ জন আহত হয়েছে।
রোববার (১৪ জুলাই) রাত সোয়া তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে মৌখিকভাবে তাৎক্ষণিক পদত্যাগ ঘোষণা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হাসান তালুকদার।
এর আগে রাত সাড়ে ১১ টায় ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে’ এমন খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থীরা ৷ এরপর তারা একটি প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে আসেন।
এরই প্রেক্ষিতে হল প্রাধ্যক্ষকে এ ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য রাত পৌনে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ওই হলের সম্মুখে অবস্থান নেন। এসময় আন্দোলনকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এরই মধ্যে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হোসেন তালুকদারের সঙ্গে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আলোচনায় বসতে দেখা যায়। এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন নবনিযুক্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. আলমগীর কবীর।
সমস্যার সমাধান না হওয়ায় রাত আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আবার মিছিল নিয়ে পুনরায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে আসলে মুখোমুখি অবস্থান নেন হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা
এসময় আন্দোলনকারীদের অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করতে রাস্তা আটকে স্লোগান দিতে থাকে উক্ত হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
পরে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬ ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর চেয়ার, লাঠিসহ হামলা করেন। এছাড়া এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আর রাফি চৌধুরী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল্লাহর সম্পৃক্ততার বিষয়টি নজরে আসে। হামলার ঘটনায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে আহসান লাবিব, সোহাগী সামিয়া, তৌহিদ সিয়াম ও মেহরাব সিফাতসহ একজন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে আহসান লাবিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে এবং সোহাগি সামিয়াকে এনাম মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ হলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার” স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের হলেও এমন স্লোগান দেয়ার পরিকল্পনা করেন ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা৷ এমন সময় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের মো. সাঈফ খান ৪৯ ব্যাচের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে একটি ম্যাসেজ দেন। নিচ তলার ১২৪ নং কক্ষ থেকে স্লোগান পুরো হলে ছড়িয়ে পড়ে৷ এসময় শিক্ষার্থীরা সমস্বরে স্লোগান দিতে শুরু করলে পলিটিকাল ব্লক থেকে ৪৮ ব্যাচের সিনিয়ররা এসে তাদের সবাইকে ডেকে ডাইনিংয়ে আসতে বলে। ১২৪ নং কক্ষ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের কাউসার আলম আরমান, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আশিক ও ইংরেজি বিভাগের জাহিদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এসময় ডাইনিং হলে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডাইনিং হলে ডেকে আনার পর শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ স্লোগান দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। এসময় ‘শিবির’ সন্দেহে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নিয়ে ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজ চেক করা হয়৷ এসময় দীর্ঘসময় পর্যন্ত ডাইনিং হল থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পান হলের শিক্ষার্থীরা৷ পরে সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে তাদের স্লোগানের জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হয়৷ ছাত্রলীগের নেতারা এসময় হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদারকে সেখানে নিয়ে আসেন৷ হল প্রভোস্টের উপস্থিতিতে ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে ক্ষমা চান। এরপর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তাদের কোন প্রকার মারধর করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন তারা৷
এদিকে ঘটনাস্থলে প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবীরসহ কয়েকজন শিক্ষক দুই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দেন ও নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে গালাগাল করেন।
তবে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা না করে উল্টো উসকে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদারের বিরুদ্ধে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি জানান। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাত সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। পরে উপ-উপাচার্যের উপস্থিতিতে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার।
উল্লেখ্য, সোমবার সকাল ১১টায় উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভোর সাড়ে চারটার দিকে নিজ নিজ হলে ফিরে যান।