গান্ধীজীর স্বদেশি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা নাসিরুদ্দিন সরকার নামে এক ব্যক্তি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কাপাশহাটিয়ার নিভৃত পল্লিতে গড়ে তুলেছিলেন গান্ধী আশ্রম। দেশভাগের পর আশ্রমের কার্যক্রম বন্ধ হলেও ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পুনরায় চালু হয় সেই আশ্রমের কার্যক্রম। এর পাশে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। প্রতিষ্ঠান দুটির নানা স্মৃতিচিহ্ন দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থী।
মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি চেতনাকে ধারণ করে ১৯৩৪ সালে জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাসিরুদ্দিন সরকার জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কাপাশহাটিয়ায় গড়ে তুলেছিলেন গান্ধী আশ্রম। সে সময় নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা কর্মপরিকল্পনা ছাড়াও চরকায় সুতা তৈরি, নারীদের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ, লেখাপড়াসহ গ্রামের মানুষকে নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো এ আশ্রম থেকে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এ আশ্রমের কার্যক্রম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পুনরায় চালু করা হয় আশ্রমটির কার্যক্রম।
এ আশ্রমের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের স্বাবলম্বী করে তুলতে বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সেলাইসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গান্ধী আশ্রমের সে সময়কার ঘরটিকে অক্ষত রেখে সেখানে সুতা তৈরির চরকা, গান্ধীর কিশোর বয়স থেকে শুরু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ছবি এবং তার বাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিসংগ্রামে বাঙালির বহুমাত্রিক ও বর্ণাঢ্য ইতিহাস সংরক্ষণের মহৎ উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে একই আঙিনায় গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন এবং জামালপুর জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে দ্বিতল জাদুঘর ভবন ও অডিটরিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। এই মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে ব্রিটিশ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রামের নানা ছবি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে জামালপুরের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া জাদুঘরের পক্ষ থেকে মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন স্মারক, তথ্যউপাত্ত, আলোকচিত্র, দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজও চলছে।
মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক কালপর্বভিত্তিক ইতিহাস গ্যালারিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ আশ্রম ও জাদুঘর দেখতে আসেন শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীরা। নিভৃত পল্লিতে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতিটি পরতে মিশে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের নানা গল্প, যা থেকে নতুন প্রজšে§র অনেকেই এখানে এসে লাভ করতে পারছে প্রকৃত শিক্ষা। ইতোমধ্যে ইতিহাসের এই বাতিঘর দুটি পরিদর্শন করে গেছেন সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ভারতের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী গণেশ হালুই, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সুবীর চৌধুরী ও এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহিমের মতো নামি ব্যক্তিরা।
নাসিরুদ্দিন সরকারের নাতি ও ট্রাস্টি সদস্য হিল্লোল সরকার জানান, মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে আশ্রমটি গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিসংগ্রাম ইতিহাসের সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের এই একটি স্থানে এক সঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠান।
গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের পরিচালক উৎপল কান্তি ধর বলেন, গান্ধীর স্বদেশি চেতনা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠান দুটি কাজ করছে। আগামীতে সারা দেশের মুক্তিসংগ্রামের সব ইতিহাস এখানে সংরক্ষণ করা হবে।
সৌরভ আবিদ