Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:16 am

জালিয়াতি করে সভাপতি হলেন শেখ ফরিদ আহমেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁদপুর জেলা বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে বড় ধরনের ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী, জেলা কমিটির সম্মেলন জেলা শহরে হওয়ার কথা থাকলেও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক নিজের স্বার্থে সে সম্মেলন তার নিয়ন্ত্রণাধীন সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের নানুপুরে আয়োজন করেন। ফলে অনেক কাউন্সিলর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সে অধিবেশনে যোগ দেননি। তাছাড়া জেলায় যত কাউন্সিল ভোট রয়েছে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক ভোট পড়েছে বলে ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা গেছে। মূলত নিজের সভাপতি পদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুরো অধিবেশনে নিজের কব্জায় একটি পাতানো ভোটের আয়োজন করা হয়েছে বলে জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন।

জানা গেছে, গত ২ এপ্রিল চাঁদপুর জেলা বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদপুর জেলা বিএনপির মোট কাউন্সিল ভোটারের সংখ্যা এক হাজার ৫১৫টি। কিন্তু দুই প্রার্থীর ভোট হিসাব করে দেখা যায়, মোট ভোট পড়েছে এক হাজার ৬৩৮টি। এর মধ্যে বিজয়ী প্রার্থী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক পেয়েছেন ৯২৭ ভোট এবং বিজিত প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক পেয়েছেন ৭১১ ভোট। মোট ভোটের তুলনায় কাউন্সিল অধিবেশনে বেশি ভোট পড়েছে ১২৩টি। জেলার নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন অনেক কাউন্সিলর ভোট দিতেই যাননি, সে ক্ষেত্রে এক হাজার ৫১৫ ভোট পুরোপুরি কাস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে মোট ভোটের চেয়ে ১২৩ ভোট বেশি কাস্ট হওয়া অবিশ্বাস্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক এমডি মাহবুবুর রহমান শাহীন শেয়ার বিজকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় জেলা বিএনপির কাউন্সিল আয়োজন করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক নিজের স্বার্থে জেলা কমিটির সম্মেলন ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি ভেন্যুতে আয়োজন করে নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কাউন্সিলর বলেন, চাঁদপুরে নজিরবিহীন কারচুপির মাধ্যমে কাউন্সিল অধিবেশন করা হয়েছে। জেলার কাউন্সিল চলে গেছে ইউনিয়নে। এতে সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ বিরাজ করছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এদিকে সম্মেলনে বিভিন্ন উপজেলায় ভোটের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট শামছল হক মন্টুর তত্তাবধনে সদরের পার্শ্ববর্তী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৃথক ভোট গ্রহণ করা হয়। সেখানে প্রকৃতপক্ষে ৩০০ জন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করলেও সেখানে ভোট দেখানো হয়েছে ৯০০। এছাড়া কাউন্সিলরদের মধ্যে মৃত ও প্রবাসী ৫১ জন। অনেকেই বলছেন, এতে বিএনপির ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শুধু একজন বিতর্কিত নেতার জন্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে, তা কোনো অবস্থাতেই চাঁদপুরের নেতাকর্মী কেন, দেশ-বিদেশের কোনো নেতা-কর্মী মেনে নিতে পারেননি।

মতলব উত্তর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল হক জিতু বলেন, চাঁদপুরে নজিরবিহীন কারচুপি করে নিজের ইচ্ছামতো কাউন্সিল করেছেন শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক। এমনকি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী দেওয়ান শফিকুজ্জামানের বাড়িতে তিন দফা হামলা করে

 ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চাঁদপুর জেলা শহর থেকে সম্মেলন সরিয়ে নানুপুরে নিয়েছেন। মূল কথা এ ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ এ কাউন্সিল আমাদের গণতন্ত্রের সংগ্রামকে খাটো করেছে।

অপরদিকে সম্মেলনের আগেই দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ তীব্র হতে শুরু করে। এরই মধ্যে একপক্ষ দুই দফায় সংবাদ সম্মেলন করে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৫ মার্চ সভা চলাকালে শাহরাস্তি ও হাজিগঞ্জ নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরদের ওপর হামলা ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় সাতজন আহত হন।

জানা যায়, চাঁদপুরে বিএনপির মোট সাতটি পৌরসভা ও আটটি উপজেলা মিলে ১৫টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ইউনিটই মানিকের আয়োজনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন বর্জন করে পৃথক অধিবেশন করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি পদে ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে ২০১৪ সালে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে তাদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে। ফলে বিগত কয়েক বছর নতুন করে সম্মেলন করার ঘোষণা দেওয়া হলেও নানা কারণে তা ভেস্তে যায়।

সংবাদ সম্মেলন ডেকে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং এবারের সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রতিদ্বদ্বী প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক অভিযোগ করেন, অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে চাঁদপুর শহরে নয়, রাজধানী কিংবা প্রতিটি উপজেলায় আলাদা ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন করা হোক। এ সময় বর্তমান নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট শামছুল হক মন্টুকে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল ফোন করা হলে ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন কোনো কথা বলতে পারব না। আমার চাচি মারা গেছেন। পরে এ বিষয়ে কথা হবে।’

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড ছাড়াও এক নেতার এক পদ নীতিতে প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা না করার কারণে ভোটারদের মাঝে ক্ষোভ, অন্তর্দ্বদ্ব ও নির্বাচনের জটিলতা আরও বেগবান হয়। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মী ও ভোটারদের হুমকি দেয়ার পাশাপাশি দফায় দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও হামলার ঘটনা বিস্তারিতভাবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূইয়া ও কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। কিন্তু এতে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে তারা অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সংযোগ পাওয়া যায়নি।