জাল ভিসায় শেনজেনভুক্ত দেশে পাঠানো হয়েছে ২৫০ জনকে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ট্যুরিস্ট ভিসায় শেনজেনভুক্ত (ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড ও জার্মানিসহ ২৬টি দেশে) দেশগুলোয় লোক পাঠানোর নামে অভিনব প্রতারণা হচ্ছে খোদ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সুযোগ বুঝে ট্যুরিস্ট ভিসায় অথবা ভুয়া ভিসায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং শেনজেনভুক্ত বিভিন্ন দেশে ১৬-১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে গত দেড় বছরে ২৫০ জনকে অবৈধ পন্থায় পাঠানো হয়েছে।

ধরা পড়ার পর তাদের অনেককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে শূন্য হাতে, কেউ জেল খেটেছেন, কেউ এখনও রয়েছেন সেসব দেশের কারাগারেই। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবিতে নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ‘মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আমরা অনেকবারই বলেছি, এরপরও বিভিন্ন পন্থায় তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে শেনজেন ভিসাভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোয় যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এজন্য সক্রিয় রয়েছে দালালচক্র। একসময় দেখা যেত নৌপথে লিবিয়া বা ইউরোপীয় দেশ ইতালিতে যাওয়ার পথে অনেকে মারা যেতেন। অনেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতেন। এরপর জেল খাটতেন। কেউ কেউ কাজ পেয়ে যেতেন। এখন এ পন্থায় ইউরোপ যাওয়ার পথ কঠিন হচ্ছে।

সর্বশেষ গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে বিমানবন্দর থানাধীন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা টার্মিনাল ২-এর পাশে গোপনে অবৈধভাবে জাল ভিসা ব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজশে বিদেশে পাঠানোর পাঁয়তারা চলছিল।

বিষয়টি টের পেয়ে এপিবিএন সদস্যরা তাদের কৌশলে নজরদারিতে রেখে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগকে খবর দেয়। এপিপিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে চক্রের দুই হোতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও মোহাম্মদ কবির হোসেনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেনÑ বিদেশ যেতে ইচ্ছুক যাত্রী জানে আলম, সাব্বির মিয়া ও সম্রাট সওদাগর।

এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছেÑতিনটি পাসপোর্ট, ৩টি জাল ভিসা, ৪টি এনআইডি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের স্পেশাল কার্ড, ৪টি মাস্টার/ভিসা কার্ড, ৫টি মোবাইল, ৩টি ই-টিকিট, ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা সংশ্লিষ্ট ৫/৬ পাতা জাল ডকুমেন্ট, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নগদ ১৬ হাজার টাকা।

লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, ‘আদালতের নির্দেশে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে গ্রেপ্তারদের। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনজন যাত্রী স্বীকার করেছে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে এই অবৈধ পথে ফ্রান্স, ইতালি এবং গ্রিসে যাচ্ছিলেন তারা। দুই হোতার বক্তব্যে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারও কারও এই চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন নতুন পন্থা অবলম্বন করছে দালালচক্র। তারা বাংলাদেশ বিমানের সিকিউরিটি ম্যান, কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী, কিছু জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ দক্ষ কম্পিউটার অপারেটর মিলে শক্তিশালী একটি চক্র, যারা ট্যুরিস্ট ভিসার কথা বলে শেনজেন ভিসাভুক্ত দেশে কোনো রকম পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। একবার পৌঁছে গেলে আর ফেরত আসতে হবে না, এই বলে কারও কারও কাছ থেকে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে।’

ডিবিপ্রধান বলেন, ‘চক্রটির কাজ হচ্ছে বিমানবন্দরে কোনো রকমে ঢুকিয়ে দেয়া। এরপর ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট করে দেয়। ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়ার জন্য ভুক্তভোগীরা টিকিট পেয়ে বিমানবন্দরে ঢোকে। বোর্ডিং আনতে গেলে গ্রেপ্তার বাংলাদেশ বিমানের সিকিউরিটি ম্যান ও কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী তখন দেখে। তারা বলে সব ঠিক আছে। ইমিগ্রেশনেও চেক করা হয় না। বিদেশগামী ভুক্তভোগীরা কিছু না বুঝে ভুয়া বোর্ডিং কার্ড নিয়ে বিমানে উঠে চলে যান।’

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, ‘এভাবে ফাস্ট ডেস্টিনেশন বাংলাদেশ থেকে তারা উড়াল দিলেও

অনেক সময় বিদেশগামীরা মধ্যবর্তী স্থানে ট্রানজিট পয়েন্টে আটক হয়, কখনও সর্বশেষ ফ্রান্স, জার্মান অথবা ইউরোপের ডেস্টিনেশনেও গিয়ে আটক হন।’

কারণ এসব জায়গায় চেক করতে গিয়ে দেখে তারা ভুয়া। তখন তাদের কাউকে দেশে পাঠায়, কাউকে কাউকে জেলে পাঠানো হয়। যারা জেলে যায় তারা পরবর্তীতে কেউ কেউ কাজও পেয়ে যায়। চক্রের সদস্যরা এ সুযোগটি নেয়।

এ প্রতারণায় জড়িত কিছু জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেলস এজেন্সি, এয়ারলাইনস ও কম্পিউটার অপারেটর মিলে এসব করছে জানিয়ে ডিএমপির ডিবিপ্রধান হারুন বলেন, ‘বুধবার একই কায়দায় ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানোর চেষ্টাকালে টের পান এপিবিএন সদস্যরা। এপিবিএন ডিবি পুলিশকে খবর দিলে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

ডিবিপ্রধান বলেন, ‘১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা বারবার বলছি, সাবধান করছি। জালিয়াতি বা প্রতারণার খপ্পরে পড়ছি কি না, তা চেক করার জায়গা তো আছে। আমরা চেক করলে, ভেরিফিকেশন করলেই বোঝা যায় এসব ভুয়া নাকি আসল।’

তিনি বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত। ডিবির এই কাজে যারা জড়িত তাদেরও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, এয়ারলাইনসের সিনিয়র কর্মকর্তা, সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার, সুপারভাইজাররা জড়িত থাকতে পারে বলে তথ্য পেয়েছি। যদি জড়িতই না থাকবে, তাহলে এয়ারলাইনসের সিনিয়র কর্মকর্তারা কীভাবে বোর্ডিং পাস দিয়ে দেয়। তাদের সম্পর্কে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। অবৈধ লোকদের ব্যাপারে তারা কেন কঠোর হয় না, টিকিট বোর্ডিং পেয়ে যাচ্ছে, বিদেশেও চলে যাচ্ছে।’

‘দেড় বছরে আড়াইশো মানুষকে অবৈধভাবে পাঠানো হয়েছে। গ্রেপ্তার পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা জেনেছি, পুরো চক্র মিলে ২৫০ মানুষকে প্রলোভনে ফেলে ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠিয়েছে। যাদের অনেকে মানবেতন জীবনযাপনের পর দেশে ফিরে এসেছে। কেউ এখনও জেল খাটছে। এই চক্রটির সঙ্গে এ জন্যই সিনিয়র কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা। আমরা অবশ্যই রিমান্ডে নিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব, তারা কীভাবে টাকাটা হাতিয়ে নিচ্ছে। কারণ এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কিছু দালাল চক্রের সদস্যরাও রয়েছে’Ñবলেন হারুন অর রশীদ।

বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবেÑজানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশের নিয়োগের প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে অনেক কিছুর ব্যাপারে আমরা তদন্ত করেছি এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের বাইরে একথা পিছপা হয়নি। আমরা তদন্তকাজ শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সে অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আশা করছি, যারাই জড়িত থাকুক; সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।’

 

 

 

 

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০