অমৃত চিছাম: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তাই এদেশে বিদ্যমান প্রতিটি শিল্পই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিল্পকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা একেবারে বেমানান। বর্তমানে দেশে সম্ভাবনাময় যে কয়েকটি শিল্প খাত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো জাহাজভাঙা শিল্প। দেশে জাহাজভাঙা শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। জাহাজভাঙা শিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, জাহাজের সব উপকরণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বদৌলতে জাহাজভাঙা শিল্প পুরো বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশেও দিন দিন জাহাজভাঙা শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। বলে রাখা ভালো এই যে, বর্তমানে জাহাজভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে জাহাজভাঙা শিল্প হলো পুরোনো ও বাতিল, ডুবন্ত বা পরিত্যক্ত জাহাজ কারখানা বা কোনো সুবিধাজনক স্থানে কেটে ইস্পাত, তামার তৈরি ধাতব পদার্থ, ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি, সংযোজিত সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য পদার্থ আলাদা, সংরক্ষণ এবং বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার কাজকর্ম-সংক্রান্ত শিল্প। এটি একটি শ্রমমুখী শিল্প। সাধারণত একটি জাহাজের ৯৫ শতাংশই মাইল্ড স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়। ২ শতাংশ স্টেনলেস স্টিল এবং বাকি ৩ শতাংশ থাকে বিভিন্ন ধাতবের মিশ্রণ। আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ও বিশ্ববাজারে দিন দিন শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নত দেশগুলো জাহাজভাঙা শিল্প থেকে বেরিয়ে এসে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যের ডকইয়ার্ডে সর্বশেষ জাহাজভাঙা হয়েছিল ৫০ বছর আগে। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ পরিত্যক্ত জাহাজভাঙা হতো চীনে। কিন্তু বর্তমানে তারাও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দিকে বেশি নজর দিতে শুরু করেছে। ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল, জনবহুল দেশ, যেখানে উপযোগী সমুদ্র-তীরবর্তী এবং পুরোনো জাহাজসামগ্রীর চাহিদা আছে। এর ফলে দেশে দিন দিন জাহাজভাঙা শিল্প সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে শিপ ব্রেকিং (জাহাজভাঙা) শিল্প যাত্রা শুরু করে ১৯৬০ সালের দিকে। দারিদ্র্যপীড়িত উন্নয়নশীল বাংলাদেশের সামষ্টিক ও ক্ষুদ্র অর্থনীতির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসন্ধান করে জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে দেশে প্রথম জাহাজভাঙা শিল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম উপকূলে সংঘটিত এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে গ্রিক জাহাজ ‘এমডি আলপাইন’ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বঙ্গোপসাগরের তীরে আটকে যায়। জাহাজটি আর সাগরে ভাসানো সম্ভব না হওয়ায় সেখানেই বেশ কটি বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরে ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম স্টিল হাউস কর্তৃপক্ষ জাহাজটি কিনে নেয় এবং সম্পূর্ণ জাহাজ কয়েক বছর ধরে ভেঙে স্ক্র্যাপে পরিণত করে। দেশে এখান থেকেই মূলত জাহাজভাঙা শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জাহাজ ‘আল আব্বাস’ মিত্র বাহিনীর গোলাবর্ষণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এটি উদ্ধার করে ফৌজদারহাট সমুদ্রতীরে আনা হয়। ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস লিমিটেড নামের একটি স্থানীয় প্রতিস্থান জাহাজটি কিনে নেয় এবং স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে। এভাবেই শুরু হয় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পের কার্যক্রম। ১৯৮০ সালের পর থেকে মূলত জাহাজভাঙা কার্যক্রমটি শিল্পে পরিণত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশীয় অনেক উদ্যোক্তা এ শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন। বর্তমানে সময়ে দেশের জন্য এই শিল্প একটি বড় ও লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়েছে। এমনকি ওই শিল্প প্রতি বছর কর প্রদানের মাধ্যমে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে। দেশে প্রতি বছর জাহাজভাঙা শিল্প থেকে আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য করের মাধ্যমে ১২০০-১৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়, যা জাতীয় অর্থনৈতিকে একধাপ এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমাংশে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল ঘেঁষে ভাটিয়ারি থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ডের কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জাহাজভাঙা শিল্প খাত বিস্তার লাভ করেছে। এখানে কমবেশি ১৬০টির মতো ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে, এর মধ্যে ৪০-৫০টি সারা বছর রিসাইকলের কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। আর এর অন্যতম একটি কাঁচামাল হলো লোহা বা আয়রন। দেশে প্রতি বছর লোহার চাহিদা ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। এত বিশাল পরিমাণ লোহার চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি ছাড়া কোনো উপায় আছে কি? হ্যাঁ অবশ্যই আছে। দেশে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় লোহা বা আয়রন এর প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখেই চট্টগ্রাম সমুদ্রসৈকত থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে জাহাজভাঙা শিল্প। দেশের লোহার চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ আসে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। এতে একদিকে যেমন লোহার চাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধির পথে একধাপ এগিয়ে যাবে। বলে রাখা ভালো যে, দেশে লোহার কোনো খনির অস্তিত্ব নেই। দেশে কম বেশি সাড়ে তিনশ বড় স্টিল রিরোলিং মিল রয়েছে। এসব মিলের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে পরিত্যক্ত জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবহার করা হয়। ২০১৮, ২০১৯ সালে জাহাজভাঙা শিল্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। ২০২০ সালে করোনা অতিমারির সময়ও বাংলাদেশ একাই বিশ্বের ৩৮.৫ শতাংশ রিসাইকেল করেছে। বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা সংস্থা শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালেও জাহাজভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস অ্যান্ড রিসিক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্যমতে, দেশে ২০১৮ সালে ১৯৬ টি, ২০১৯ সালে ২৩৬টি, ২০২০ সালে ১৪৪টি এবং ২০২১ সালে ২৫৮টি জাহাজভাঙা হয়েছে। জাতীয় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জাহাজভাঙা শিল্পের অবদান অপরিসীম। নির্মাণশিল্পসহ অর্থনৈতিকভাবে এ শিল্পের অবদান অনেক। দশ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে দুই লাখ শ্রমিক সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এ শিল্প থেকে অক্সিজেন কারখানা, ক্যাবল, পিভিসি, সিরামিক ও আসবাবপত্র তৈরির উপকরণও সংগৃহীত হয়। বার্ষিক ৩৫ হাজার টনের বেশি সিজন করা কাঠ এবং আসবাবপত্রের জোগান আসে এ শিল্প থেকে, যা বনজ সম্পদ ও গাছপালা রক্ষার্থে পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার সংরক্ষণ এবং সঠিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে জাহাজভাঙা শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার ভাঙন রোধসহ মানুষের আবাসিক ব্যবহার উপযোগী অঞ্চল তৈরিতে এ শিল্প ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলার যুক্ত হচ্ছে এ শিল্প থেকে। জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিক বিধিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ বাসেল কনভেনশনস ১৯৮৯, হংকং কনভেনশনস ২০০৯, আইএলও’র পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কনভেনশন ১৯৮১, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইএলও গাইডলাইনস ২০০১ এবং আইএমও গাইডলাইনস ২০১২। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে এ শিল্পের জন্য ১২টি আইন ও প্রবিধান প্রণীত হয়েছে। সব আইন ও প্রবিধান এ শিল্পের নিরাপত্তা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাহাজভাঙা শিল্পের এই বিশাল অগ্রগতি স্বীকার করলেও এখন এর পরিবেশগত দিক নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। একই সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও তাদের স্বাস্থ্যগত দিকের নিরাপত্তা বিধানের প্রতি আরও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। পরিবেশগত ঝুঁকির দিকগুলো চিহ্নিত করে তা কীভাবে দূর করা যায় এবং একই সঙ্গে এ বিকাশমান শিল্পকে এগিয়ে নেয়া যায়, সেটা খতিয়ে দেখা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দুটি খাত হলোÑশিল্প ও কৃষি। এছাড়া বর্তমানে নতুন নতুন অনেক শিল্প-কলকারখানা চালু হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনি দেশের অর্থনীতির গতিও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজভাঙা শিল্পও জাতীয় অর্থনীতি, সর্বোপরি দেশর সার্বিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। জাহাজভাঙা শিল্পের প্রসারের ফলে একদিকে যেমন উদ্যোক্তারা লাভবান হবে ঠিক তেমনিভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিও কিছুটা সাবলম্বী হবে। তাছাড়া দেশে জাহাজভাঙা শিল্পের প্রসারের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর, পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধি হবে, সর্বোপরি পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে সম্ভব হবে। জাহাজভাঙা শিল্পকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সবুজ শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করা হয়েছে। সর্বোপরি ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাহাজভাঙা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
শিক্ষার্থী
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ