জাহাজভাঙা শিল্প : একে একে খেলাপি হচ্ছেন উদ্যোক্তারা

 

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামভিত্তিক রাইজিং গ্রুপটির প্রধান ব্যবসা ছিল ইস্পাত ও জাহাজভাঙা। কয়েক বছর ধরে এ খাত দুটিতে ধস নামায় গ্রুপটির অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। গ্রুপটিকে জাহাজ আমদানি করতে ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেয়। সব মিলে পাঁচটি ব্যাংকে এ গ্রুপটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা। একই অবস্থা চট্টগ্রামভিত্তিক সিলভিয়া গ্রুপের। এর কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা।

অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইস্পাত খাতের চাঙ্গা সময়ে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকায় ব্যবসায়ী সিরাজুদ্দৌলা গড়ে তোলেন পাকিজা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। এতে ভালো মুনাফা হলে পাকিজা স্টিল রি-রোলিং মিলস (পিএস স্টিল) ও পাকিজা অক্সিজেন প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করেন। পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ সুবিধা পান সিরাজুদ্দৌলা। বর্তমানে এ ব্যবসায়ীর কাছে ছয় ব্যাংকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা আটকে আছে। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাত খাতে মন্দা শুরু হলে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েন এসব উদ্যোক্তা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকায় পরিশোধ করতে পারেননি ব্যাংকের পাওনা।

বলাবাহুল্য, জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত এসব উদ্যোক্তার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়া ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। এ শিল্পে ব্যাংকের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মন্দা ও ২০১৩ সালে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় লোহার চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্প সংকটে পড়েছে বলে এ খাতের উদ্যোক্তারা দাবি করছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর একটা বড় অংশ রয়েছে জাহাজভাঙা শিল্পে। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স ব্যবসায়ীদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাকি দেড় হাজার কোটি টাকা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ। ব্যবসায় মন্দার কারণে একে একে এ খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এতে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন ইস্পাত শিল্প ও জাহাজভাঙা শিল্প খাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বড় গ্রুপ হিসেবে আছে সিলভিয়া গ্রুপ ও রাউজিং গ্রুপ।

এদিকে ঋণের টাকা পরিশোধ না করে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে। অনেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করার ভয়ে তাদের কার্যালয়ও গুটিয়ে ফেলেছেন। অনেকে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এতে করে টাকা ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায় অন্তত ২০টি ব্যাংক। এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ অনুমোদনে আস্থা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্ট ও জাহাজভাঙা শিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সিলভিয়া গ্রুপের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পায় ১৯৭ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ১৪০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১২৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ১৪৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮৯ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৪৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪৩ কোটি টাকা, শাহ্জালাল ৭ কোটি ২০ লাখ ও যমুনা ব্যাংকের ঋণ আছে ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এ গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা। তাদের নেওয়া সব ঋণই এখন খেলাপি। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেই দেশ ছেড়েছেন উদ্যোক্তারা। বিএনপির নেতা আসলাম চৌধুরী গ্রেফতারের পর আলোচনায় আসে এ গ্রুপের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে দেনার বিষয়টি। এ গ্রুপের পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা।

এ খাতের আরেক আলোচিত ব্যবসায়ী হচ্ছেন সিরাজুদ্দৌল্লা। এ ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন পাকিজা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড, পাকিজা স্টিল রি-রোলিং মিলস (পিএস স্টিল) ও পাকিজা অক্সিজেন প্ল্যান্ট এ তিন প্রতিষ্ঠানে ছয় ব্যাংকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ আটকে আছে। প্রথম দিকে  ভালো মুনাফা হলে পরে ব্যর্থতায় বন্ধ হয়ে যায় এসব প্রতিষ্ঠান। এ খাতের প্রতিষ্ঠান লিজেন্ড হোল্ডিংস ১৬২ কোটি টাকা জাহাজভাঙা ব্যবসার প্রয়োজনে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যবসায় সফল না হওয়ায় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া চিটাগাং ইস্পাত লিমিটেডের কাছে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখা, পূবালী ব্যাংক সিডিএ শাখা ও ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ১২৪ কোটি, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৬০ কোটি, আহমেদ মুজতবা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের এনসিসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ও ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৬৩ কোটি, এসএম স্টিল গ্যালভানাইজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৪৩ কোটি, কিউএস স্টিলের ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২ কোটি, সাকিব স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের ঢাকা ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখা ৩১ কোটি, এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ১৯ কোটি, আবরার স্টিলের ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা ১৬ কোটি ও আলভি স্টিল এন্টারপ্রাইজের ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৯১৫ টাকাসহ  এখাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০ ব্যাংকের পাওনা ১৪ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আবু তাহেরসহ একাধিক সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, আন্তর্জাতিক মন্দা ও ২০১৩ সালে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় লোহার চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্প সংকটে পড়েছে। এ শিল্পের অধিকাংশ উদ্যোক্তার অবস্থা ভালো না। ব্যাংক থেকে নেওয়া টাকা ফেরত না দিতে পারায় কেউ কেউ আড়ালে চলে গেছেন। দুই বছর আগেও ১২৫টিরও বেশি ইয়ার্ড চালু ছিল। এখন তা ৩০-৩৫টিতে নেমে এসেছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আর বন্ধ হয়ে যাওয়া অধিকাংশই ব্যাংক ঋণে জড়িত হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের কর্ণধার ও একাধিক শিপ ইয়ার্ড ব্যবসায়ী বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি কিছু ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ীর কারণে জাহাজভাঙা শিল্প আজ সংকটের মুখে পড়েছে। এখন বেশিভাগ ইয়ার্ড লোকসানে পড়েছে। ব্যাংকগুলো এ শিল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ ব্যাংকের। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কোনো মর্টগেজও নেয়নি। শুধু বিশ্বাসের ওপর এ খাতের উদ্যোক্তাদের টাকা দিয়েছে। এ অবস্থায় কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন নানান ইস্যু নিয়ে আবার তোড়জোড় শুরু করেছে। যার কারণে জাহাজভাঙা শিল্প বন্ধ হওয়ার পথে। তিনি বলেন, আস্থার সংকটের কারণে এ খাতের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানে আগ্রহী নন। ফলে ব্যবসায় সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় অর্থ সংকটে আছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। তিনি আরও বলেন, আমদানি করা জাহাজ ইয়ার্ডে এনে ভাঙা পর্যন্ত প্রতি টনে খরচ পড়ে ৪১-৪২ হাজার টাকা। আর জাহাজভাঙা প্লেটের বাজারমূল্য ছিল প্রতি টন সাড়ে ৩১ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি টন ইস্পাতে প্রায় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। যার ফলাফল হিসেবে আজ এ অবস্থা।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংকগুলো কোনো রকম বাছ-বিচার ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। কে ব্যবসায়ী আর কে ব্যবসায়ী নয়, তা দেখেনি। এখন ব্যাংক দেখতে পাচ্ছে অব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে কি ভুলটাই না করেছে। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না।

ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন ঋণ দেওয়া হয়, তখন তাদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান, কর্ণধারের বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। অর্থ আদায়ে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এ নিয়ে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চাপে আছেন শাখা ব্যবস্থাপকরা। ফলে নতুন করে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে অনেকটা রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করছেন এসব ব্যবস্থাপক।

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০