সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম:স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরের ৯০ থেকে ১০০টি জাহাজ পণ্য খালাস এবং পণ্য নিয়ে অপেক্ষা করে। আর বন্দরের ৪৮ হাজারের বেশি কনটেইনার পড়ে থাকত। অথচ এখন ৫০ থেকে ৫৫টি জাহাজ এবং সাড়ে তিন হাজার হ্যান্ডলিং করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানিবাহী জাহাজ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। অথচ দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর দিয়ে দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশ হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ১ মার্চ বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে পণ্যবাহী খালাসযোগ্য জাহাজ ছিল ৫৩টি, ৪২টি থেকে পণ্য খালাস হচ্ছে। এর মধ্যে পণ্যবাহী কোনো কনটেইনার জাহাজ অপেক্ষায় নেই। অথচ মন্দার আগে ৯০ থেকে ১০০টি পণ্যবাহী জাহাজ থাকত। অন্যদিকে বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মোট ৫৩ হাজার ৫১৮টি কনটেইনার সংরক্ষণ করার সক্ষমতা আছে। কিন্তু বর্তমানে সক্ষমতার ৫২ শতাংশই খালি পড়ে আছে। গত ১ মার্চ বন্দরের পরিবহন শাখার পরিসংখ্যান অনুসারে বন্দরের কনটেইনার ছিল ২৫ হাজার ১৮৯টি। অথচ স্বাভাবিক সময়ে বন্দর ইয়ার্ডে ৪২ থেকে ৪৫ হাজারের বেশি কনটেইনার থাকত। একই সময়ে বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারিও কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। গত ১ মার্চ বন্দর থেকে ডেলিভারি নেয়া হয় তিন হাজার ৬৫৭টি, যা স্বাভাবিক সময়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার।
দেশে ব্যাংকিং খাতে কয়েক মাস ধরে ডলার সংকট চলছে। এ সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন রকমের আমদানি পণ্য আমদানিপত্র খোলার ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। ফলে আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। এর প্রভাবে গত কয়েক মাস ধরে বন্দরের জেটি ফাঁকা থাকছে। জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং কম হচ্ছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২টি জেটি খালি ছিল। একইভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ৩টি, ২৬ ফেব্রুয়ারি ৪টি, ২৭ ফেব্রুয়ারি ৭টি এবং ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ৫টি জেটি খালি ছিল। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ১৮ শতাংশ করে জেটি খালি ছিল। এ ছাড়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কনটেইনার জাহাজ কনটেইনার নামিয়ে চলে যেতে পারছে। অথচ কভিডকালেও এত খালি ছিল না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানির জন্য ৩ হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৮৩৮ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বরে ৪২৫ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা এর আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৫৬০ কোটি ডলার। ফলে এক মাসের ব্যবধানে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি ডলার, যা আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৪০২ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ।
চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী বলেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন রকমের আমদানি পণ্য আমদানিপত্র খোলার ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পণ্যের সঠিক দাম যাচাইয়ের কঠোরতা দেখাচ্ছে। এতে খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমদানিকারকদের ভোগান্তির কারণে এলসি খোলার হার আগের মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। আবার কোনো কোনো ডলার সংকট বলে ব্যাংক সরাসরি এলসি নিচ্ছে না। এ কারণে অধিকাংশ গ্রাহক এলসির জন্য এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ঘুরছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। সব ঠিক থাকার পরও কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিচ্ছে, এই এলসি খোলা যাবে না। আর আগের দায় পরিশোধে দফায় দফায় সময় নিচ্ছে। ফলে নতুন প্রজšে§র ও ছোট ব্যাংক এলসি খোলা এক রকম বন্ধই রেখেছে। আমাদের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এলসি না খোলার জন্য বলা হয়েছে। এ কারণে আমাদের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অনেক আমদানিকারক বিপাকে পড়েছেন। অথচ একটা সময়ে আমরা ব্যাংকাররা এলসি দেয়ার জন্য গ্রাহকের কাছে যেতাম এবং অনুরোধ করতাম। আর এখন গ্রাহক আমাদের ১০০ শতাংশ মার্জিনে এলসি খোলার জন্য অনুরোধ করছে। অথচ এলসি দিতে পারছি না।