২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকেই দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কা সামলে গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। তাই দেশে মন্দা থাকলেও বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। ফলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় বিশ্বের ৩৮ শতাংশ জাহাজই ভাঙা হয়েছে চট্টগ্রাামের শিপইয়ার্ডগুলোয়। এতে জাহাজ ভাঙায় বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জাহাজ ভাঙা ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাপী এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
জাহাজ ভাঙা শিল্পের উন্নতিতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে পিছিয়ে থাকলেও আমাদের জাহাজ ভাঙা শিল্প এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কর্মীদের অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। কেউ মারা গেছেন, কেউ আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/ কত প্রাণ হলো বলিদান/ লেখা আছে অশ্রুজলে’ গানটি মুক্তিসংগ্রামের উদ্দীপনামূলক গান হিসেবে অনেকেরই পরিচিত। জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের জন্যও গানটি প্রযোজ্য বললে ভুল হবে না। এর বাইরে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের আশপাশের বিস্তৃত এলাকার মানুষ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতির সম্মুখীন। মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যে কোনো উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ।
জাহাজ ভাঙা শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও মারাত্মক পরিবেশগত ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাই জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে শ্রমিকের স্বাস্থ্য, পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়ও ভাবতে হবে। নানা কারণেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশ অন্যতম স্থান হিসেবে পরিগণিত। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তুলনামূলক কম খরচ। এতে বিপুলসংখ্যক দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, কুমিরা, জোড়ামতল, মাদামবিবিরহাট, কদমরসুল, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, শীতলপুর ও বারো আউলিয়া প্রভৃতি এলাকার সাগরপাড়ে গড়ে উঠেছে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সিংহভাগ। প্রতি বছরই এসব ইয়ার্ডে সনাতনী পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে বিস্ফোরণ ও বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে এবং লোহার পাত পড়ে প্রাণ হারান অনেক শ্রমিক। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকি তো আছেই। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেক শ্রমিক। এসব শ্রমিকের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না, সেটি দেখতে হবে। এ ধরনের বিপর্যয়ের আগেই জাহাজ শিল্প শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো অনিয়ম যেন সম্ভাবনাময় এ শিল্পের গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে পুরোনো জাহাজ ব্যবহার করা হয়। এসব জাহাজে তেজস্ক্রিয়তা ও ক্ষতিকর বর্জ্য থাকতে পারে। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছাড়পত্র পাওয়ার পরই জাহাজ কাটা শুরু করার বিধান চালু করতে হবে। পরিত্যক্ত জাহাজ কাটার ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘পরিবেশগত ছাড়পত্র’ বাধ্যতামূলক। এ নিয়ম যাতে ঠিকমতো পরিপালিত হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।