তরুণ কান্তি বড়ুয়া: বর্তমান সময়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অন্যতম একটি শিল্পমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচলের যোগ্যতা হারিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সেসব জাহাজের মালিকরা জাহাজগুলো উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বিক্রি করে থাকে। প্রতিবছর গড় হিসেবে প্রায় ৬০০টি পুরোনো পরিত্যক্ত জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভাঙা বা কাটা হয়ে থাকে। আর এ শিল্পকে কেন্দ্র করে এসব দেশের সমুদ্রসৈকত এলাকায় বড় বড় জাহাজ ভাঙা বা রিসাইক্লিং শিল্প গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আমাদের দেশের অনেকেই এ শিল্প ব্যবসায় ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ শিল্প নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করলেও বিপরীতভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য হারাতে এ শিল্প বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো এ শিল্পের প্রতি প্রবল মনোযোগী ও উৎসাহী হয়েছে। আলং নামক ভারতীয় এক কোম্পানি ১৯৮২-২০০৩ সাল পর্যন্ত মোট তিন হাজার ৮০০ মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ ভেঙেছিল, যা বছরে গড়ে প্রায় ১৮১টি। একই কোম্পানি ১৯৯৬-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছর ২৫০টি জাহাজ ভেঙেছিল। এতেই অনুমান করা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রভাব কতটা সক্রিয়। ১৯৮০ সালের পর থেকে জাহাজ ভাঙার কার্যক্রমটি মূলত শিল্পে পরিণত হয়। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল এবং ২০১২ সালে ছিল তৃতীয় স্থানে। আমাদের দেশের রড ও ইস্পাতের বাণিজ্য অনেকটা জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। মূলত বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পের অবস্থান চট্টগ্রামকে ঘিরে। চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী, ফৌজদার হাট, কুমিরা ও সীতাকুণ্ডের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছোট-বড় অনেক জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে উঠেছে। বেসরকারি তথ্যমতে, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সরাসরি এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং ৩০ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে এ শিল্প ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভর করে চট্টগ্রামের হাজারের অধিক স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙার কর্মকাণ্ড চলমান। উন্নত দেশগুলোয় বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন নতুন পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙা হয়ে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙার কাজ চলে আসছে। তবে একটি সূত্রমতে জানা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় পরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী শিপইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৬ থেকে ১৮টি শিপইয়ার্ডকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাদের দাবি অনুযায়ী শিপইয়ার্ডগুলোয় ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙার পরিবর্তে অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে জাহাজ ভাঙার কাজটি শুরু হতে যাচ্ছে। মেরিন ইনসাইট নামের একটি সংগঠনের জরিপমতে, বর্তমান বিশ্বে জাহাজ ভাঙার ১০টি পদ্ধতি চালু আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিটি হচ্ছে সমুদ্রসৈকতে জাহাজ এনে স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে জাহাজ ভাঙা। এ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রধান কারণ হচ্ছে, স্বল্প খরচ ও লোকবল পাওয়ার নিশ্চয়তা। জাহাজ ভাঙা কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উন্নত দেশগুলোয় এ শিল্পের প্রসার নেই বললে চলে। তাছাড়া এসব জাহাজের মধ্যে নানা রকম ক্ষতিকর উপাদান থাকে। জাহাজের লোহার ওপর এসবেস্টস ব্যবহার ক্ষতিকারক হওয়ায় আশির দশকের মাঝামাঝি জাহাজ নির্মাণে এসবেস্টস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আসলে এসবেস্টসমিশ্রিত ধুলাবালি মানবদেহের ফুসফুসে প্রবেশ করে মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। তাছাড়া পুরোনো জাহাজ থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য সমুদ্র উপকূলের পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে। জাহাজ ভাঙা শিল্প ইদানীং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়, যথা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ আরও কিছু দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, তুরস্কÑএই পাঁচটি দেশ বিশ্বের পরিত্যক্ত জাহাজের প্রায় ৭০-৮০ ভাগ জাহাজ রিসাইক্লেনিং করার জন্য নিয়ে আসে। এ চিত্র থেকে বোঝা যায়, এশিয়ার দেশগুলোয় এ শিল্পের প্রসার কতটা বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত জাহাজ ভাঙা শিল্পে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। জাহাজ ভাঙা শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার জোগান দিয়ে আসছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক এ শিল্পে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রামে আরেফিন এন্টারপ্রাইজ নামের এক শিপইয়ার্ডে ম্যাক্স নামের ২৪ বছরের এক পুরোনো জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োজিত ছিলেন মোহাম্মদ বিপ্লব নামের এক শ্রমিক। ইঞ্জিন কক্ষে পাইপ দিয়ে আগুন ধরানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটলে ছিটকে পড়ে বিপ্লবের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়। তার মুখ মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় এবং পিঠের হাড় ভেঙে যায়। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথোপযুক্ত সহায়তা না পেয়ে বিপ্লবকে নিজের সব জমিজমা বিক্রি করতে হয়েছিল। নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে আরেফিন এন্টারপ্রাইজ বিপ্লবের আট দিনের চিকিৎসা খরচ বাবদ মাত্র ১৬০ মার্কিন ডলার খরচ বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী তার পাওয়ার কথা ছিল দুই হাজার মার্কিন ডলারের মতো।
মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনমতে, বিদেশি কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম উপেক্ষা করে যেসব স্থাপনায় পর্যাপ্ত পরিবেশ ও শ্রম সুরক্ষা বিধি মানা হয় না, সেসব স্থাপনায় ভাঙার জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজগুলো রপ্তানি করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালে করোনার পর জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল। গত তিন বছরে বাংলাদেশের প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ৫২০টিরও বেশি জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োজিত ছিল, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্ধৃতি দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজ ভাঙা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। অথচ এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ যথেষ্ট অপ্রতুল। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্ধৃতি অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে এ শিল্পে কর্মরত ৬২ শ্রমিক মারা যায়, যার মধ্যে ২২ জন মারা যায় ২০১৯ সালেই। জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে ঘটা পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাণহানির বিষয়টি বিবেচনায় এনে বলা যায়, এটি উপকূলীয় শ্রমিকদের জীবন ধ্বংসের একটি অনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ অনৈতিক কর্মযজ্ঞে শুধু যে স্থানীয় জাহাজ ভাঙা মালিকরা সুবিধা ভোগ করে তা নয়, উন্নত দেশের মালিকরাও যথেষ্ট সুবিধা পেয়ে থাকে। বেসরকারি সংস্থা জাহাজ ভাঙা প্ল্যাটফর্মের মতে, ২০০৫ সাল থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার জাহাজ ভাঙা শিল্প চত্বরে দুর্ঘটনায় ২৪৯ শ্রমিক নিহত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে জাহাজ ভাঙার আগে জাহাজগুলোকে দূষণমুক্ত করার কথা থাকলেও অধিকাংশ মালিক এসব নিয়মনীতি মেনে চলে না, ফলে রাসায়নিক বর্জ্য নির্গত হয়ে পার্শ্ববর্তী পরিবেশ ও সাগরের পানিতে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাহাজ ভাঙা শিল্পের অবদান অন্যান্য শিল্পগুলোর মতো উল্লেখ্যযোগ্য না হলেও এটি দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃত। নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও জাহাজ ভাঙা শিল্পের একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রয়েছে। এ শিল্পকে অগ্রসর করতে হলে মালিক-শ্রমিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান না করে বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা এবং পুনর্ব্যবহারকারী সমিতি সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে এ শিল্পকে ‘লাল’ থেকে ‘কমলা’য় শ্রেণিবদ্ধ করতে, যাতে তাদের পরিবেশগত মূল্যায়নপত্র নেয়ার প্রয়োজন না হয়। এটি সর্বৈব অযুক্তিযুক্ত ও হাস্যকরও বটে। জাহাজ ভাঙা শিল্পের ক্ষতিকর দিকটি সবার আগে বিবেচনায় এনে পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জাহাজ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে এ শিল্প মালিকদের প্রচলিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে। পরিহারযোগ্য সব দুর্ঘটনা এড়াতে মালিকদেরকে শ্রমিকদের জীবন সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনাজনিত অবকাঠামোগত ‘খুন’ বন্ধে শিল্প মালিকদের যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে, যাতে জাহাজ ভাঙা শিল্প মরণফাঁদে পরিণত না হয়। জননিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর আইনগত নির্দেশনা থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে একটি শক্তিশালী কারিগরি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সাবেক অধ্যক্ষ
রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম