ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে দেশটির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মহলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। পরে দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের আবেদন হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি। জিআই সনদ দেয়ার কর্তৃপক্ষ শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর-ডিপিডিটি সেদিনই আবেদন গেজেটভুক্ত করতে বিজি প্রেসে পাঠায়। জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ির গেজেট প্রকাশিত হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। গেজেট প্রকাশের পর আইনত দুই মাস অপেক্ষার পর কোনো আপত্তি না এলে এই শাড়ি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান। এর আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত নতুন দেশ বাংলাদেশ। আমাদের যুদ্ধের আগে-পরে নৈতিক সমর্থন ও অন্যবিধ সহায়তা করে ভারত। এখন বন্ধু ভারত আমাদের দেশীয় একটি পণ্যকে নিজেদের জিআই পণ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি নয়, খোদ সরকারই এ স্বীকৃতি দেয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক ব্যথিত। সবচেয়ে বড় বিষয় ১৯৪৭ সালের আগে একদেশ ছিলাম, দেশ বিভাগ-পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কারিগরদের একাংশ ভারত চলে যান। সেখানে তারা একই পেশায় থাকেন এবং যেহেতু টাঙ্গাইল শাড়ি যেহেতু আগে থেকে বিখ্যাত, তাই নিজেদের পণ্যকে টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত করেন। এদিকে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাঁতিরাও বংশ পরম্পরায় নিজেদের পেশা ধরে রেখেছেন। তারাও টাঙ্গাইল শাড়িকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে টাঙ্গাইল জেলা আছে। এ নামে ভারতে কোনো স্থান নেই। তাই ভারতের স্বীকৃতি দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না বলেই আমরা মনে করি।
আমাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব অন্য যেসব পণ্যের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সেসব পণ্য যেমনÑ জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল প্রভৃতি সেগুলো স্বীকৃতি দেয়া। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ দুটির অভিন্ন ও সমনামের পণ্য যত দ্রুত সম্ভব জিআই সনদভুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জিআই বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা। টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই ভারতের জিআই পণ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। শনিবার ‘টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি: প্রক্রিয়া, পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জিআই পণ্য ভৌগোলিক এলাকার সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কাজেই এটি তৈরির কারিগররা স্থানাস্তরিত হলেও পণ্যের জিআই ট্যাগ স্থানান্তর হওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ জিআই স্বত্ব প্রতিষ্ঠায় অবিলম্বে ভারতের আদালতে বাংলাদেশের মামলা করা উচিত। ভারতের সংশ্লিষ্ট আইনেই এ সুযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক পণ্য ও স্থান আছে, যেগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে মিল আছে। এরই মধ্যে আটটি পণ্য ভারতে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এগুলোর মধ্যে আছেÑমালদা ফজলি আম, মালদা লক্ষ্মণভোগ আম, মালদা ক্ষীরশাপাতি, নকশিকাঁথা, বাংলার রসগোল্লা, উপাধা জামদানি, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু। এমন আরও পণ্য আছে, যেগুলোর এখনও জিআই ভারত করেনি। এসব পণ্য আমাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। এগুলো জাতীয় গর্বও বটে। তাই এগুলোর জিআই যদি আমরা প্রথমে না করতে পারি, তবে তা আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে। জাতি আমাদের ক্ষমা করবে না। বাংলাদেশ উভয় দেশের অভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার বিষয়ে আইন করতে পারে। পণ্যের উৎস ও এর নিবন্ধন নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারত কেউই লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। জিআই পণ্যের স্বীকৃতিদানের মতো গুরুত্বপর্ণ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য থাকার কথা নয়। সরকার এজন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে বলেই প্রত্যাশা।