জিপিএ-৫ কি জীবনের সব?

দেওয়ান রহমান: এবারের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন দুপুরে খুব কাছের এক ছোট ভাই কল দিয়ে জানালো তার মন খুব খারাপ। জানতাম, ওই দিন ওদের এইচএসসির ফল প্রকাশিত হবে। সে ভালো ছাত্র, ভালো রেজাল্ট আশা করে। আমিও আশাবাদী ছিলাম তার ভালো করার ব্যাপারে। তার মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিলো জিপিএ-৫ মিস হয়েছে অল্পের জন্য। তার রেজাল্ট এসেছে ৪.৯২। সে মেডিকেল, ঢাবিসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়ায় সে নাকি ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তার ভেতরে জেগে ওঠা ধারণা হলো জিপিএ-৫ না পাওয়ায় সে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এই ধারণা তার ভেতর হীনম্মন্যতার জন্ম দিয়েছে।

এ সমস্যা শুধু তার একার নয়। পুরো প্রজন্মই জিপিএ-৫ জ্বরে ভুগছে। জিপিএ-৫ কে ভালো ছাত্র-খারাপ ছাত্রের মানদণ্ড ধরে অভিভাবকদের অস্থিরতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। গাদাগাদা নোট, গাইড, প্রাইভেট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি আর পড়ার চাপে তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের দুরন্ত কৈশোর। জীবন ও বাস্তবমুখী শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে তাদের শেখানো হচ্ছে পড়ো এবং পড়ো, যেকোনো মূল্যে জিপিএ-৫ চাই। অভিভাবকরা চিন্তা করে না তার সন্তান কতটা বাস্তবমুখী, জীবনের সঙ্গে কতটা মিশতে পেরেছে, তার সামাজিকীকরণ, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া কতটুকু অর্জিত হলো। পাশের বাসার মেয়ে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে কিংবা ক্লাসের সেকেন্ড বয় বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে; নিজের ছেলে কেন পেল না জিপিএ-৫ কিংবা ক্লাসে ফার্স্ট বয় হওয়া সত্ত্বেও কেন বোর্ডে স্ট্যান্ড করতে পারল না, তা নিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ওপর চালায় এক দারুণ মানসিক নির্যাতন। চারপাশের লোকজনের হাসি-তামাশা, আত্মীয়স্বজনের তিতকুটে কথা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে একটা জিপিএ-৫ না পাওয়া ছেলে বা মেয়ের সামনে পরিবেশটা হয়ে উঠে ভারী আর অন্ধকার। অনেক আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থী এসব মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের এক দিনের মধ্যেই ১৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রত্যাশানুরূপ ফল না করায় ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। এসব তরুণ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার জন্য দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থা তথা জিপিএ-৫ নামক মানদণ্ড। বৃক্ষ ঠিকমতো ডালপালা না ছড়াতেই যারা ফল লাভের বোঝা বাড়িয়ে বৃক্ষের অকালপ্রয়াণে ভূমিকা রাখে তারা যেমন বৃক্ষের খুনি হিসেবে সাব্যস্ত, তেমনই জিপিএ-৫ এর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করা অভিভাবক ও শিক্ষকরাও সম-অপরাধী।

জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য পড়াশোনা কোনো অপরাধ নয় কিন্তু জিপিএ-৫ কে একমাত্র লক্ষ্য রেখে পড়াশোনা করা অবশ্যই সামাজিক ব্যাধি। শিক্ষক, অভিভাবক ছাড়াও কিছু ভুঁইফোড় অনুপ্রেরণাদায় বক্তা (মোটিভেশনাল স্পিকার) রয়েছে যাদের প্ররোচনায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়। অধিক ভিউ ও সাবস্ক্রাইবারের আশায় এসব স্পিকার শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু জিপিএ-৫ এর জন্য পড়াশোনা করার তাগিদ দেয়। জিপিএ-৫ না পেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, জিপিএ-৫ মানেই ভালো শিক্ষার্থী এসব উক্তি প্রদান করে তারা অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে।

শিক্ষার উচ্চতম ধাপ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এর মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। লেখার শুরুতে উল্লেখ করা আমার ছোট ভাইয়ের মতো সব শিক্ষার্থী মনে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার মূল সূত্র হচ্ছে জিপিএ-৫। যার জিপিএ-৫ নেই, তার কোনো সুযোগ নেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসলেই কি তাই?

একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এর পেছনে যৌক্তিক কারণ হচ্ছে বাস্তবমুখী জ্ঞান অর্থাৎ জিপিএ-৫ এর আশায় শুধু পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে না রেখে জীবন ও বাস্তববোধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শেখা। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমার নিজেরও এসএসসি, এইসএসসি কোনোটায়ই জিপিএ-৫ নেই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করি আমার জিপিএ আমার চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখেনি। বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় পরিস্থিতি আমাকে অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে।

শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের বিচার করা হয় অর্জিত শিক্ষাকে আমরা কতটুকু বাস্তবে প্রতিফলিত করতে পেরেছি সেই আলোকে। সেটা হতে পারে চাকরির পরীক্ষা, বিসিএসসহ যেকোনো কিছু।

সদ্য প্রকাশ হওয়া এইসএসসি রেজাল্ট যাদের মনমতো হয়নি তাদের উদ্দেশে বলব, এখানেই শেষ নয়। জীবনে টিকে থাকতে হলে লড়াই করা জানতে হবে। পড়াশোনাকে প্রায়োগিকভাবে নিয়ে এর বিস্তার সবার মাঝে ভাগ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে জিপিএ-৫ কখনো কারও ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারবে না। একজন পাঠ্যবইকেন্দ্রিক জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রের থেকে জীবনমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র সবসময়ই এগিয়ে থাকবে। জিপিএ-৫ তোমাকে একটু ভালো সার্টিফিকেট দেবে বটে, প্রায়োগিক জ্ঞান তোমাকে দেবে সুন্দর ভবিষ্যৎ।

শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০