Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:38 am

জীবনমান ও উপার্জনে গ্রামের চেয়ে পিছিয়ে শহুরে শ্রমিক

হামিদুর রহমান: বর্তমান সময়ে ব্যয় বেড়েছে প্রায় সব ক্ষেত্রে। এতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা। কম বেতন, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও পুষ্টিহীন খাবারে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান তলানিতে। ঘণ্টা হিসেবে ডিউটির তুলনায় আয়ের দিকে পিছিয়ে রয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শ্রমিকরা। রাজধানীসহ মফস্বলের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও সেই অনুপাতে শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটেনি। বরং তাদের রোজগার না বাড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। শ্রমিকরা বাসাভাড়া ও পেট চালানোর পর যে অর্থ থাকে, তা বাড়িতে পাঠাতে হয়। রোগে আক্রান্ত হলে ঠিকমতো শ্রমিকরা যথাযথ চিকিৎসাসেবাও গ্রহণ করতে পারেন না। তবে শহরের তুলনায় বর্তমানে গ্রামে কৃষক বা অন্য শ্রমিকদের আয়-ব্যয় ও জীবনযাত্রার মানসহ সবদিক থেকেই সুযোগ-সুবিধা ভালো। শহরে আয় কিছুটা বেশি হলেও দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর পর তা গ্রামে আয়ের চেয়ে কমে যায়।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের বেশিরভাগ শ্রমিকদের খাওয়া-দাওয়া অত্যন্ত নিন্মমানের। আলু ভর্তা, ডাল, পাঙ্গাশ মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও ব্রয়লার মুরগিই তাদের ভরসা। তারপরও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকমতো খাবারের সংস্থান করতে পারেন না অনেকে। ফলে নানা রোগে জর্জরিত তারা। আবার আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ শ্রমিক ধারদেনায় জর্জরিত। এনজিওর কিস্তির টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার মগবাজারের এসে রিকশা চালান মঞ্জু মিয়া। তিনি জানান, ঢাকায় যা আয় হয়, তা ঢাকাতেই থাকছে। বাড়িতে পাঠানো যাচ্ছে না। সবকিছুর দাম বাড়তি। বাইরে এখন খোলা বেকারির ছোট্ট একটা কেক বা পাউরুটি দাম ১৫ টাকা। সারাদিন রিকশা চালিয়ে ৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকাও আয় হয়। রিকশার জমা ও তিন বেলা খাওয়ার জন্যই ৪৫০ টাকা চলে যায়। বাড়িতে আমার দুই ছেলে বাবা-মা আছে। সবাইকে দেখতে হয়। বাড়িতে সামান্য কিছু জমি আছে, সেখানে শাকসবজি হয়। আগে পরিবার চালানো গেলেও এখন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’

অন্যদিকে একটি কমপ্লায়েন্ট গার্মেন্টের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি প্রায় আট হাজার ৯০০ টাকা। ওভার টাইমসহ ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। তবে নন-কমপ্লায়েন্ট অনেক গার্মেন্ট আছে, যেখানে বেতন পাঁচ-ছয় হাজার টাকা, ওভারটাইমসহ সাত-আট হাজার টাকা আয় হয়। এসব অনেক গার্মেন্টের ওভারটাইমও ঠিকমতো হয় না। একজন শ্রমিকের রুমভাড়া ও তিন বেলা খাবারসহ প্রতি মাসে প্রায় ছয়-সাত হাজার টাকা ব্যয় হয়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, পোশাক শ্রমিকদের ডিউটির জন্য হাঁটতে হয় বহু পথ। আবার তুলনামূলকভাবে পোশাক শ্রমিকরাই বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। স্বল্প বেতন দেয়ায় খুব বেশি দূরত্বের রাস্তা ছাড়া ২০-২৫ মিনিটের মতো পথ অনেক শ্রমিক হেঁটেই যাতায়াত করেন। আবার বেতন বোনাস পেতে মাঝেমধ্যেই ভোগান্তির শিকার হতে হয়, অনেক সময় রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। অন্যদিকে এই শ্রমিকদের বেশিরভাগের বাসস্থান অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ছোট রুমে একসঙ্গে বেশি মানুষের বসবাস। অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ও গোসলের জন্য লাইনে অপেক্ষাসহ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া খাবার মেন্যুতেও থাকে না বেশিরভাগ পুষ্টিকর খাবার।

টঙ্গীর পোশাক শ্রমিক ফাতেমা আক্তার বলেন, ছয় বছর থেকে গার্মেন্টে কাজ করছেন। তার স্বামী নিরাপত্তা কর্মীর চাকরি করেন। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে থাকছেন টঙ্গিতে। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘ছয় বছর গার্মেন্টে কাজ করলেও ভাগ্য বদলায়নি। বড় ছেলেও গার্মেন্টে কাজ করে ছয় হাজার টাকা বেতনে। ছোট এক ছেলে ও মেয়ের পড়ালেখার খরচ, বাসাভাড়া আর বর্তমানে বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বাড়ায় সংসার প্রায় চলছেই না।’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির জেনারেল সেক্রেটারি জুলহাস নাঈম বাবু শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পোশাক খাত দেশের রপ্তানি খাতে ভূমিকা রাখলেও গার্মেন্ট মালিক ও সরকার তাদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ।’

ঢাকায় একজন চামড়া বা জুতা কারখানার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রায় সাত হাজার ৪৬০ টাকা। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে কাজ করা একজন গৃহকর্মী তিন বেলা খাবার পান। সঙ্গে মাসিক বেতন প্রায় ছয় থেকে ১০ হাজার টাকা, নিরাপত্তা কর্মীর বেতন প্রায় আট থেকে ১৫ হাজার টাকা। তবে কিছু নিরাপত্তা কর্মী একবেলা বা দুবেলা খাবার ফ্রি পেয়ে থাকেন। আর যারা ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসায় নিরাপত্তার কাজ করেন, তাদের বেতন প্রায় আট হাজার টাকা। ভালো বেসরকারি কোম্পানিতে নিরাপত্তা কর্মীর বেতন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বেসরকারি অফিসের আয়া, বুয়া, ক্লিনার ও পিয়নের বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তবে বেসরকারি অফিসে তাদের কেউ আবাসিক সুবিধা পান না।

আবার ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় ছোট-মাঝারি কারখানায় শ্রমিকদের মাসিক বেতন প্রায় ১০ হাজার টাকা। অন্যদিকে গ্রামে একজন ইজিবাইক চালক প্রতিদিন আয় করে থাকেন প্রায় ৬০০ টাকা, গ্রামে কৃষি ফার্মে হাস, মুরগি, গরুসহ অন্যান্য ফার্মে একজন নারী শ্রমিকের প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ৫০০ টাকা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান বাজার অনুযায়ী ঢাকায় বসবাসরত একজন ব্যক্তির মাসিক খরচ পাঁচ হাজার ৩৩৯ টাকা। চার সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের মাছ-মাংস বাদ দিয়ে প্রতি মাসে কেবল থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ ৩৩ হাজার ৮৪১ টাকা।

সিপিডির গবেষণার তথ্যমতে, দেশের কোনো শিল্প খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিই চার সদস্যের পরিবারের এক মাসের খাবার খরচ, অর্থাৎ ২১ হাজার ৩৫৮ টাকার কাছাকাছি নয়। এমনকি মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি বাদ দিয়েও মাসিক আট হাজার ১৬ টাকা খাবার খরচও কোনো কোনো খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে শ্রমিকদের আয়ের টাকা দিয়েও সংসার পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

যদিও শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ এখন বেশি স্বাবলম্বী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, শহরে আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় থাকা খাওয়া বাবদ। গ্রামে এই বাড়তি খরচগুলো নেই। গ্রামে নানা রকম কাজের সুযোগ আছে। অনেকেই খামার গড়ে তুলেছেন, কেউ অটোরিকশা চালান। আবার অনেকে দিনমজুর ক্ষেতে কাজ করার পাশাপাশি দু-একটি গরু পালন করেন। এতে বছর শেষে কিছু অর্থ সঞ্চয় হয়। তাছাড়া শহরের তুলনায় গ্রামে শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় ব্যয় অনেক সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। 

জামালপুরের অধিবাসী আবদুল মিয়া। আগে ঢাকায় থাকতেন। তবে কভিড মহামারির প্রথম দিকে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। বর্তমানে কেমন চলছে সংসারÑতা খোঁজ নিতে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘গ্রামে এসেছি দুই বছর হলো। গত বছর এক লাখ ২০ হাজার টাকায় গরু কিনে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। সেই টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কট (ইজারা) রেখেছি। প্রতি মৌসুমে জমিতে ফসল হচ্ছে। এ বছরও আশা করছি তিন লাখ টাকার মতো গরু বিক্রি করতে পারব। গ্রামে অনেক ভালো আছি। বাড়িতে এখন অনেক কিছু কিনে খেতে হয় না। নিজের এলাকায় সেই শৈশবকালে ফেরার মতো অনুভূতি। শহরে থাকায় এই প্রশান্তিগুলো ভুলতে বসেছিলাম।’