জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব ও রক্ষায় করণীয়

জেবা ফারিহা: আমাদের এই জীবজগতে বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস। তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় প্রজাতিগত, বৈশিষ্ট্যগত, অবস্থানগত ও খাদ্যাভাব নানা ধরনের পার্থক্য; এটাই জীববৈচিত্র্য। এই পার্থক্য থাকার কারণে আমাদের জীবজগতে এক অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য দেখা যায়।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে ১৯৯৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের জন্য নির্ধারণ করা হয়। তবে ২২ মে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্যবিষয়ক কনভেনশনে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

জীববৈচিত্র্যের বাস্তুতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। জীববৈচিত্র্য জীবজগতের শক্তিমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। জীবজগতে যদি সবসময় একই প্রজাতির বা বৈশিষ্ট্যের জীব থাকত তাহলে একসময় সব জীব বিলুপ্ত হয়ে যেত। এছাড়া মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন প্রজাতির জীবকে ব্যবহার করে উপকৃত হয়।

জীববৈচিত্র্য মানবজীবন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করলে জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। গাছপালা, বন-জঙ্গল কেটে জায়গা দখল করে। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর এগুলো ভরাট করা হচ্ছে। ভরাট করার পরে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে আমাদের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বর্তমানে বাংলাদেশের বনভূমি প্রায় ১৫ শতাংশ যা খুবই নগণ্য।

বাংলাদেশ এর জীববৈচিত্র্য এর অবস্থাও হুমকির মুখে পড়েছে। প্রথমত, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় কেটে, বন ধ্বংস করে রোহিঙ্গা শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে রয়েছে। অনেক বন্যপ্রাণী মারা  গেছে। দ্বিতীয়ত, বুড়িগঙ্গা নদীর পানি। বাংলাদেশের সব থেকে বড় একটি নদী কিন্তু ধ্বংসের মুখে। পুরো ঢাকা শহরের সব ময়লা গিয়ে পড়ে এই বুড়িগঙ্গা নদীতে। শিল্পনগরীর সব ময়লা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এতে নদীতে থাকা সব প্রাণী মারা যাচ্ছে। নদীর ময়লা পানি নদীদূষণ করছে। ফলে নদীর বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

অতীতে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, ঘন জঙ্গলে ও গাছপালায় ঘেরা একটি সবুজ দেশ। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় বন্ধন। কত মনোরম দৃশ্য! গাছপালা, পাখির কলকাকলি এবং নদীর শব্দ মানুষের সব অবসাদ, ক্লান্তি দূর করে দেয় এবং শক্তি দেয়। কিন্তু মানুষ যত উন্নতি করছে তত স্বার্থপর হয়ে উঠছে এবং জীবজগৎ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। কারণ জীববৈচিত্র্য ধীরে ধীরে হুমকির মুখে পতিত। ফলে জলবায়ু হুমকির মুখে পতিত। অতীতে দেখা যায়, এত ঝড়, বন্যা, টর্নেডো এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এত ছিল না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে ঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ কষ্ট পায়। অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়, ওজোনস্তর ক্ষয় হয়। অনেক পাখি তার বাসস্থান হারায়। বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়।

আমরা রাস্তাঘাটে বা যেখানে সেখানে প্লাস্টিক বা পলিথিন জাতীয় বস্তুগুলো ফেলে দিয়ে আসি। কিন্তু এগুলো মাটির সঙ্গে মিশতে পারে না বরং মাটি ও পানি দূষণ করে। সমুদ্রে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক বেড়াতে যায় এবং এই পলিথিন ফেলে দিয়ে আসে। সমুদ্রের প্রাণীরা না বুঝে কেউ কেউ এগুলো খাবার হিসেবে গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ পলিথিনের সঙ্গে পেঁচিয়ে যায়। এতে প্রতিবছর সমুদ্রের প্রাণী মারা যাচ্ছে এবং সমুদ্র দূষণ হচ্ছে।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের করণীয় অনেক। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। শিল্পায়ন করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। গাছপালা, বন-জঙ্গল কাটা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটা নগরে বা শহরে গাছ দিয়ে ঘেরা পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র গঠন করতে হবে। প্লাস্টিক বা পলিথিনের পরিবর্তে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাটের তৈরি জিনিস মাটিতে পচতে সাহায্য করে, যা খুবই উপকারী। পাহাড় কাটা, বন্যপ্রাণী মেরে ফেলা; এসব বন্ধ করতে হবে। ছোট ছোট উদ্ভিদ, তৃণমূল এমনকি জমিতে কীটনাশক নিষিদ্ধ করতে হবে। অনেক ধরনের বর্জ্য মাটিতে ফেলা হচ্ছে, ফলে মাটি দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই মাটি দূষণ রোধ করতে হবে।

সর্বোপরি, উপরিউক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। সংবিধান এর ১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছেÑরাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।”জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতিমালা তৈরি করে সেটা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। তাহলেই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজš§কে একটি সুস্থ পরিবেশ উপহার দিতে পারব।

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০