শফিকুল ইসলাম খোকন: সংসার পরিচালনায় যেমন বিছানা, হাঁড়ি-পাতিল, ঘর, খাদ্যদ্রব্যসহ যাবতীয় জিনিসপত্রের প্রয়োজন তেমনি একটি রাষ্ট্র বা দেশ পরিচালনার জন্য আইন, বিধি, দপ্তর, প্রশাসন ইত্যাদি দরকার ঠিক তেমনি ওই রাষ্ট্রের জন্য প্রকৃতি জীববৈচিত্র্য দরকার। আর সেই জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বনভূমি বা বনাঞ্চল দরকার হয়। পরিবারের সব সদস্যের সমন্বয়ে যেমন সংসার পরিচালনার বিকল্প নেই, তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বনভূমিও রক্ষা করতে হবে।
গত ২২ মে ছিল জীববৈচিত্র্য দিবস। কিন্তু দুঃজনক বিষয় হলো আমাদের কতজনই দিবসটির কথা জানি। মানুষের বসবাসের জন্য জীববৈচিত্র্য যে কতটা জরুরি, সেটিও বেশির ভাগ মানুষের অজানা।
সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের মতো পৃথিবী একটি গ্রহ। এখানে শুধু মানুষ বাস করে না; তার সঙ্গে রয়েছে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা ইত্যাদি। এছাড়া নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, গিরিশৃঙ্গসহ কত কিছু! মোদ্দাকথা, পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে অন্যান্য জীবজগতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুধু মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিবেশকে উপেক্ষা করছি। কিন্তু বর্তমানে মানবসমাজ এমন এক সময়ের মুখোমুখি, যেখানে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার কারণে মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ শতকের আগে জনপরিসরে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন জোরদার হয়নি। সুদীর্ঘকাল ধরে পরিবেশ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদেরই জীবন বিপন্ন করে তুলেছি। তবে গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছেন জাতীয়ে পর্যায়ে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা ‘ধরা’, স্থানীয় পর্যায়ে পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, সুন্দর ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনসহ নানা সংগঠন।
এত দিন পরিবেশের ওপর আমরা এমন অত্যাচার করেছি যেন পরিবেশ ও মানুষ ভিন্ন। অথচ পরিবেশের কোনো কিছুর ক্ষতি করলে তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র। কিন্তু ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তির লোভে মানুষ হয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব ও বিবেকহীন। প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে পরিবেশ। গাছপালা কেটে তৈরি করা হচ্ছে পাকা রাস্তা। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা খাসজমি দখল করে তৈরি করছে শিল্পকারখানা। পুকুর-জলাশয় ভরাট করে খোদ সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। স্থানীয় জনগণের শত বাধা ও আপত্তি সত্ত্বেও কাউকে থামানো যাচ্ছে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পর্যন্ত মানা হয় না। জীববৈচিত্র্য, খাল-নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দিষ্টভাবে রায় থাকলেও মানা হচ্ছে না। অথচ একটি দেশে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ থাকার কথা ২৫ শতাংশ, সেখানে আছে মাত্র ১৭ শতাংশ। বন বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর ৭ শতাংশ হারে বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে। ফসলি জমি নষ্ট করে গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্প। স্বাধীনতার পর দেশের মোট জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষযোগ্য আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ শতাংশ। এখন তা বিভিন্ন কারণে কমে গেছে। কয়েক দশক আগেও ঢাকায় খাল ছিল ৫০টির মতো। এখন তা কমে সচল অবস্থায় আছে মাত্র ১০-১৫টি।
এই পৃথিবীতে বাস করে হাজারো প্রাণী। তাদের নাম, পরিচিতি আর স্বভাবের কথা তুলে ধরতে গেলে হাজার পৃষ্ঠায় কোটি শব্দ লিখলেও শেষ হবে না। আধুনিক পৃথিবীতে এখন সব জায়গাতেই মানুষের পদচারণা। মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি মিলিয়েই আমাদের পৃথিবী নামের সবুজ গ্রহটি। বিশ্ববাসীর ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র এ জীবমণ্ডলটি রয়েছে। মানুষ এটিকে এতটাই নির্দয়ভাবে ও নির্বিচারে ব্যবহার করছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ সেল ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ২২ মে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বায়োডাইভার্সিটি (সিবিডি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এরপর ৫ জুন ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ধরিত্রী সম্মেলনে সিবিডি বিভিন্ন দেশের স্বাক্ষরের জন্য উš§ুক্ত করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১৬৮টি দেশ সিবিডি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং সিবিডি ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৯৫টি। সম্প্রতি টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, বন উজাড় হওয়ায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। টিআইবি জানায়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ, ২.৬ শতাংশ। গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। আর বন বিভাগের হিসেবে সারাদেশে দখল হয়ে গেছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের সমারোহ। আমাদের রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন; রয়েছে অসংখ্য জলাভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল, বিস্তীর্ণ সমুদ্র, সেন্টমার্টিনের মতো প্রবাল দ্বীপ, যা জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। অন্যদিকে আমাদের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্য দিয়েছে। অথচ দেশে অনেক প্রাকৃতিক ও জৈবিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়Ñএই জীববৈচিত্র্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছি? নিজের অজান্তে কিংবা জেনেশুনেই অনেক সময় আমরা জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলি কিংবা জীবের বিলুপ্তি ঘটাতে ভূমিকা রাখি। বন্যপ্রাণী বা পশুপাখি, মাছ বা বনজসম্পদ দেখলেই এগুলোকে ভোগ করতে উদ্যত হই। কখনোই চিন্তা করি না এই প্রাণীকুল আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কতটা সহায়ক। আজ যে সুন্দরবন পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের একটি অন্যতম স্থান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় এটি বারবার আমাদের রক্ষা করে চলেছে, যা আমরা ভুলে যাই। তাই বন উজাড় করে আমরা যে শুধু সুন্দরবনের উদ্ভিদকুলকে ধ্বংস করছি তাই নয়, এ বনের ওপর নির্ভর করে যে প্রাণীকুল আছে, তাদেরও আমরা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। প্রজাতির বৈচিত্র্য বা সংখ্যা যত বাড়বে, সেই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য তথা স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা তত বাড়বে। অথচ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমরা নানারকম উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছি। অথচ একজন মানুষ তার মৌলিক চাহিদার প্রায় সবগুলো পূরণে এক কথায় জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। সেটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ, যেভাবেই হোক। পাথরঘাটা এবং সুন্দরবন উপকূলে কীভাবে বন উজাড় হচ্ছে তার হিসাব সরকারের কাছে নেই। মানুষের প্রয়োজনে নতুন নতুন পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত শহর ও বন্দর গড়ে উঠছে, বাড়ছে শিল্পায়ন। আর নীরবে কাঁদছে প্রকৃতি। বনাঞ্চলকে ধ্বংস করা হচ্ছে, জলাশয় দূষণের কবলে পড়ছে, জলাশয় ভরাটসহ দখল হচ্ছে এভাবে আমরা বারবার আহত করছি পৃথিবীকে। আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছি বিভিন্নভাবে। এই পৃথিবী নামক মাতৃকা যে আমাদের জঠরে ধারণ করেছে, তার ওপর প্রতিনিয়ত করছি অত্যাচার। কিন্তু ভেবে দেখছি না এর ফল কত ভয়ানক হতে পারে।
পরিবার সঠিকভাবে পরিচালনা করতে যেমন পরিবারের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়Ñতেমনি সমাজ, রাষ্ট্রের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে সকলের ঐক্যমত হয়ে কাজ করতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে বন রক্ষা করতে হবে, আর বন রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সাথে রাখতে হবে। বন ও জীববৈচিত্র্যের বিষয় তাদের ধারণা দিতে হবে। মানবকুলের জন্য জীববৈচিত্র্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝাতে হবে। রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সমন্বিত উদ্যোগ, প্রচেষ্টা এবং ঐকমত্য হয়ে কাজ না করলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে হবে।
মুক্ত লেখক, গবেষক