জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তি হয়েছে এবারের ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস টু দ্য ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (সংক্ষিপ্ত রূপ কপ) বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জার্মানির বার্লিন শহরে ১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে কিয়োটো প্রটোকলে সই করা দেশগুলো সম্মেলনে অংশ নেয়। কিয়োটো প্রটোকল হলো বহুরাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক চুক্তিÑযা এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে দায়বদ্ধ করে।
এবারের জলবায়ু সম্মেলন ২৮তম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস শুরু করার বিষয়ে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি করেছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ চুক্তি জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের চূড়ান্ত সমাপ্তির সংকেত দিচ্ছে।
বর্তমান যান্ত্রিক বিশ্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ফুয়েল বা জ্বালানির ভূমিকা অপরিহার্য। আধুনিক জীবনযাপন যেমন যন্ত্র ছাড়া ভাবা যায় না, তেমনি জ্বালানি ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতাও অসম্ভব। বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি; বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি। বলা যায়, জীবাশ্ম-জ্বালানির ওপর বিশ্বের মানবসম্প্রদায় অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই অতি নির্ভরশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে ২০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে সৃষ্ট বায়ুদূষণ দায়ী। বাংলাদেশে এ সমস্যা প্রকট। ২০১২ সালে বায়ুদূষণে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৮১ জন মৃত্যু করে। তাদের ২ লাখ ৫২ হাজার ৯২৭ জনের (প্রায় ৩৬ শতাংশ) মৃত্যু বায়ুতে উপস্থিত জীবাশ্ম জ্বালানি কণার কারণে হয়েছিল। তাই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসার চুক্তি আমাদের জন্য বড় আশার খবর।
দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য উৎসের কারণে বায়ুদূষণে মৃত্যুহার বেশ উচ্চ। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং অন্যান্য বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
রাজধানীর রাস্তায় দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট তিন চাকার যান নিষিদ্ধ করে বায়ুদূষণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো গিয়েছিল। একই কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা গেলে মৃতের সংখ্যা আরও কমানো সম্ভব। কভিড অতিমারি সংক্রমণকালে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ইতিবাচক হয়ে উঠছিল। কেবল প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল।
আমাদের উচিত হবে, যত দ্রুত সম্ভব কার্বন নিঃসরণ কমানো ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি শ্লথ করার লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়ানো। যদিও কার্বন নিঃসরণে আমাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়, তবে এর প্রতিঘাতের হিস্যা আমাদেরই অনেক বেশি নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের একটি টেকসই, অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করতে হবে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তি ও জৈব-জ্বালানি (বায়োফুয়েল) সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সম্ভাবনাময়। তাই নিরাপদ বা উত্তম জ্বালানির অপ্রচলিত উৎসের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। যেমনÑ সৌরশক্তি, বায়োফুয়েল, বায়ু প্রবাহ এবং বায়োগ্যাস প্রভৃতি। শিগগিরই আমাদের ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য ও বিকল্প শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে সব ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা প্রস্তুতি নেব, এটিই প্রত্যাশা।