আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: বিশ্ব আন্তর্জাতিক মহাদুর্যোগের মুখোমুখি। মহাদুর্যোগের কারণ মারাত্মকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। ফলে দেখা দিয়েছে জলবায়ু বিপর্যয়, যা বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করে কর্তৃত্ব ফলানোর মতো ভ্রান্ত ধারণায় মানুষ ডুবে আছে। আগেও মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে রসদ নিয়ে ইচ্ছামতো নিজের ভোগবিলাস পূরণেই ব্যস্ত ছিল, এখনও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি ঘটেছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের খবরদারির এ যুগকে বলা হয় ‘এনথ্রোপোসিন’। ফলাফল হয়েছে মানুষসহ পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্ব টিকে থাকার ওপর হুমকি।
ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের সংকটের ফলে মানুষ জীববৈচিত্র্যের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলন (কনভেনশন) থেকে উন্নয়ন ও পরিবেশের যোগসূত্র নিয়ে ভাবনা শুরু করেছে, যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। এরপর ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন (ইউএনসিইডি) সম্মেলনে (ওই সম্মেলন আর্থ সামিট নামে সাধারণের কাছে পরিচিত) এক চুক্তি সই হয়। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার এমন অবস্থায় স্থিতিশীল রাখা, যাতে জলবায়ুগত মানবিক পরিবেশের জন্য তা বিপত্তিকর না হয়।
১৯৯২ সালে ‘ধরিত্রী সম্মেলনের পর বিগত প্রায় ৩০ বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার না কমে বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রকৃতির ওপর জলবায়ু বিপর্যয়ের ধাক্কা বাংলাদেশের ষড়ঋতুর ওপরও ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। এর প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে। ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষি, বাড়ছে দুর্যোগ, ফলে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, পৃথিবীতে কত ধরনের যে উদ্বাস্তু রয়েছে, যেমনÑউন্নয়ন উদ্বাস্তু, পরিবেশ উদ্বাস্তু; এখন দেখা যাচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু।
সামগ্রিকভাবে জলবায়ু বিপর্যয় বাংলাদেশে দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে কয়েক বছর অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসও বেশি হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ চলছে সারা পৃথিবীতে। নতুন নতুন রোগও মোকাবিলা করতে হচ্ছে মানুষকে। অতীতে কোনো বিশ্বযুদ্ধও মানুষকে এত ভাবিয়ে তুলতে পারেনি, বর্তমানে জলবায়ু বিপর্যয় যেভাবে ভাবিয়ে তুলছে।
২০১২ সালে: স্টকহোম সম্মেলনে বিশ্বের তাপমাত্রাকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। এই বিষয়টিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে তারা সফলতার মুখ দেখছেন না। যদিও স্টকহোম সম্মেলনে ‘বিশ্বের স্থায়িত্বের জন্য হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক ওই বৈঠকে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ২০ নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীসহ ৫০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তবে কিয়োটো প্রটোকলের আলোকেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি নামিয়ে আনা যায়।
কী করলে এই মহাদুর্যোগ থেকে মানবজীবনসহ প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচানো যাবে, তা নিয়ে কাজ করার এখনই সময়। অনেকেই বলেন, ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান।’ কিন্তু এটি হাতে গোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউই বলছি না, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করুন, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করুন। এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে সোচ্চার নয় অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী জি-২০ দেশগুলো। বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশকে ধনী বা উন্নত দেশ বলা হয়, এটা বাস্তব, কিন্তু বিষয়টি অস্বাভাবিক। যদিও অনেক দেশের তরুণ ও স্কুলশিক্ষার্থীরা জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে বিভিন্ন সময়ে প্রতি শুক্রবারে ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ নামে মানববন্ধন, মিছিল ও সভা-সমাবেশ করে চলেছে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দেশের রাষ্ট্রনেতারা শুধু ক্ষতিপূরণ চাচ্ছেন; কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি এবং মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করতে নিজে ও জাতিসংঘের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে চাপ দিচ্ছেন না। মানুষের অস্তিত্বই যদি না থাকে ক্ষতিপূরণের অর্থ কী কাজে লাগবে? জি-২০ দেশগুলো অর্থাৎ অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হচ্ছে না।
জলবায়ু বিপর্যয় কোনো স্থানীয় দুর্যোগ নয়Ñবিশ্বব্যাপী প্রাণ-প্রকৃতি এবং সব মানুষের দুর্যোগ। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলেই তাপপ্রবাহ আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে এটা বাড়তেই থাকবে। কিছুদিন আগে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বন্যায় বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিসম্প্রতি দাবানলে পুড়ছে গ্রিস, স্পেন ও ইতালি; সেইসঙ্গে দাবদাহ ও দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপজুড়ে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের দুর্গম উত্তর-পশ্চিমে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। দাবানলে প্রায় এক হাজার ৩৩০ হেক্টর বনাঞ্চল নষ্ট হয়েছে।
জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ না করলে প্রাণ-প্রকৃতিসহ মানুষ বাঁচানোর পরিস্থিতি ক্রমে কঠিন হবে। নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে এত উদাসীনতা কাম্য নয়। এখনই প্রধান কাজ হবে সবাই পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করা; তারপর দাবিগুলো জনসাধারণ ও সরকারের কাছে জানানো।
ভিয়েতনাম সরকার কভিড প্রতিরোধে সে দেশের মানুষকে সচেতন করতে সর্বাত্মক প্রচারণা চালিয়েছিল। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ, সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক, আন্তর্জাতিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে নাও আসে, সাধারণ মানুষকে নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগে জলবায়ু বিপর্যয় রোধে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ব্যক্তিগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে, সমষ্টিগতভাবে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৩ নম্বর লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব মোকাবিলা-বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে এবং আরও ঘটবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে অনেক প্রজাতির পতঙ্গ মারা যাবে, ফলে পরাগায়ণ না হওয়ার কারণে ফুল ও ফলের উৎপাদন কমে গিয়ে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে, অনেক পাখি ও জলজ প্রাণী মারা যাবে। মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেবে, যার ফলে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে। উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব ও সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে, ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। এর ফলে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের (এসডিজি) ১, ২, ৩, ও ৬ নম্বর লক্ষ্য অর্জন অনেক কঠিন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়বে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে বর্তমান এ পৃথিবীর সঙ্গে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বোধ হয় খুব বেশি একটা মিল থাকবে না। তখন পৃথিবীর যাত্রা, বাংলাদেশের যাত্রা কোথা থেকে শুরু হবে অজানাই রইল। স্টকহোম ঘোষণার আলোকে বিশ্বনেতাদের মতামতকে মেনে নিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি নামিয়ে আনা গেলে সবারই মঙ্গল হবে। এজন্য দরকার সরকারগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com